নিবেদন
মতিচূরের কোন কোন পাঠকের সমলোচনায় জানা যায় যে তাঁহারা মনে করেন, মতিচূরের ভাব ও ভাষা অন্যান্য খ্যাতনামা গ্রন্থকারদের গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়াছে। পূর্ববর্ত্তী কোন কোন পুস্তকের সহিত মতিচূরের সাদৃশ্য দর্শনে পাঠকদের ওরূপ প্রতীতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
অপরের ভাব কিম্বা স্বায়ত্ত করিতে যে সাহস ও নিপূণতার প্রয়োজন, তাহা আমার নাই; সুতরাং তাদৃশ্য চেষ্টা আমার পক্ষে অসম্ভব। (কালীপ্রসন্নবাবুর “ভ্রান্তিবিনোদ” আমি অদ্যাপি দেখি নাই এবং বঙ্কিমবাবুর সমূদয় গ্রন্থ পাঠের সুযোগও প্রাপ্ত হই নাই। যদি অপর কোন গ্রন্থের সহি মতিচূরের সাদৃশ্য ঘটিয়া থাকে, তাহা সম্পূর্ণ দৈব ঘটনা।)
আমিও কোন উর্দ্দু মাসিক পত্রিকায় কতিপয় প্রবন্ধ দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছি-উক্ত প্রবন্ধাবলীর অনেক অংশ মতিচূরের অবিকল অনুবাদ বলিয়া ভ্রম জন্মে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ভ্রম জন্মে। কিন্তু আমার বিশ্বাস সে প্রবন্ধসমূহের লেখিকাগণ বঙ্গভাষায় অনভিজ্ঞা।
ইংরাজ মহিলা মেরী করেলীর “ডেলিশিয়া হত্যা” (The murder of Delicia) উপন্যাস খানি মতিচূর রচনার পূর্বে আমার দৃষ্টিগোচর হই নাই, অথচ অংশবিশেষের ভাবের সহিত মতিচূরের ভাবের ঐক্য দেখা যায়।
এখন প্রশ্ন হইতে পারে, কেন এরূপ হয়? বঙ্গদেশ, পাঞ্জাব, ডেকান (হায়দরাবাদ), বোম্বাই, ইংল্যান্ড-সর্বত্র হইতে একই ভাবের উচ্ছ্বাস উত্থিত হয় কেন? তদুত্তরে বলা যাইতে পারে, ইহার কারণ সম্ভবতঃ ব্রিটীশ সাম্রাজ্যের অবলাবৃন্দের আধ্যাত্নিত একতা।
কতিপয় সহৃদয় পাঠক মতিচূরে লিখিত ইংরেজী শব্দ ও পদের বাঙ্গালা অর্থ না লেখার ক্রটী প্রদর্শন করিয়াছেন। এবার যথাসম্ভব ইংরেজী শব্দসমূহের মর্ম্মানুবাদ প্রদত্ত হইল। যাঁহারা মতিচূরে যে কোন ভ্রম দেখাইয়া দিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞ আছি।
মতিচূরে আর যে সকল ক্রটী আছে, তাহার কারণ লেখিকার বিদ্যা-বুদ্ধির দৈন্য এবং বহুদর্শিতার অভাব। গুণগ্রাহী পাঠক পাঠিকাগণ তাহা মার্জ্জনা করিবেন, এরূপ আশা করা যায়।
বিনীতা
গ্রন্থকর্ত্র ।
পিপাসা (মহরত)
কা’ল বলেছিলে প্রিয়! আমারে বিদায়
দিবে, কিন্তু নিলে আজ আপনি বিদায়।
*
দুঃখ শুধু এই -ছেড়ে গেলে অভাগায়
ডুবাইয়া চির তরে চির পিপাসায়!
যখন যেদিকে চাই, কেবলি দেখিতে পাই,-
“পিপাসা, পিপাসা” লেখা জ্বলন্ত ভাষায়।
শ্রবণে কে যে ঐ “পিপাসা” বাজায়।
প্রাণটা সত্যই নিদারুণ তৃষানলে জ্বলিতেছে। এ জ্বালার শেষ নাই, বিরাম নাই, এ জ্বালা অনন্ত। এ তাপদগ্ধ প্রাণ যে দিকে দৃষ্টিপাত করে, সেই দিকে নিজের হৃদয়ের প্রতিবিম্ব দেখিতে পায়। পোড়া ছাড়া আর কিছুই দেখি না। পুস্পময়ী শস্যশ্যামলা ধরণীর আনন্দময়ী মূর্ত্তি আমি দেখি না। বিশ্ব জগতের মনোরম সৌন্দর্য আমি দেখি না। আমি কি দেখি, শুনিবে? যদি হৃদয়ে ফটোগ্রাফ তোলা যাইত, যদি চিত্রকরের তুলিতে হৃদয়ের প্রতিকৃতি অঙ্কিত করিবার শক্তি থাকিত,- তবে দেখাইতে পারিতাম এ হৃদয় কেমন। কিন্তু সে উপায় নাই।
ঐ যে মহরমের নিশান, তাজিয়া প্রভৃতি দেখা যায়,- ঢাক ঢোল বাজে, লোকে ছুটাছুটি করে, ইহাই কি মহরম? ইহাতে কেবল খেলা, চর্ম্মচক্ষে দেখিবার তামাসা। ইহাকে কে বলে মহরম? মহরম তবে কি? কি জানি, ঠিক উত্তর দিতে পারিলাম না। কথাটা ভাবিতেই পারি না,-ওকথা মনে উদয় হইলেই আমি কেমন হইয়া যাই,-চক্ষে অন্ধকারে দেখি, মাথা ঘুরিতে থাকে। সুতরাং বলিতে পারি না-মহরম কি!
আচ্ছা তাহাই হউক, ঐ নিশান তাজিয়া লইয়া খেলাই হউক; কিন্তু ঐ দৃশ্য কি একটা পুরাতন শোখস্মৃতি জাগাইয়া দেয় না? বায়ূ-হিল্লোলে নিশানের কাজড় আন্দোলিত হইলে, তাহাতে কি স্পষ্ট লেখা দেখা যায় না- “পিপাসা? উহাতে কি একটা হৃদয়-বিদারক শোকস্মৃতি জাগিয়া উঠে না? সকল মানুষই মরে বটে- কিন্তু এমন মরণ কাহার হয়?
একদিন স্বপ্নে দেখিলাম- স্বপ্নে মাত্র যেন সেই কারবালায় গিয়াছি। ভীষণ মরুভূমি তপ্ত বালুকা; চারিদিক ধূ ধূ করিতেছে; সমীরণ হায় হায় বলিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন কাহাকে খুঁজিতেছে! আমি কেবল শুনিতে পাইলাম-“পিপাসা, পিপাসা”! বালুকা কণায় অঙ্গিত যেন “পিপাসা, পিপাসা”! চতুর্দ্দিক চাহিয়া দেখিলাম, সব শূন্য, তাহার ভিতর “পিপাসা” মূর্ত্তিমতী হইয়া ভাসিতেছে!
সে দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর-তথা হইতে দূরে চলিলাম। এখানে যাহা দেখিলাম, তাহা আরও ভীষণ, আরও হৃদয়-বিদারক ! দেখিলাম- মরুভূমি শোণিত-রঞ্জিত !
রক্ত-প্রবাহ বহিতে পারে নাই-যেমন রক্তপাত হইয়াছে, অমনি পিপাসু মরুভূমি তাহা শুষিয়া লইয়াছে! সেই রুধির-রেখায় লেখা- “পিপাসা, পিপাসা”!
নবীন যুবক আলী আকবর (হোসেনের পুত্র) যুদ্ধে ক্লান্ত হইয়া পিতার নিকট পিপাসা জানাইতে আসিয়া কাতর কণ্ঠে বলিতেছেন- “আল আৎশ! আল-আৎশ!!” (পিপাসা, পিপাসা!) ঐ দেখ, মহাত্মা হোসেন স্বীয রসনা পুত্রকে চুষিতে দিলেন, যদি ইহাতে তাঁহার কিছুমাত্র তৃপ্তি হয় ! কিন্তু তৃপ্তি হইবে কি,-সে রসনা যে শুষ্ক -নিতান্ত শুষ্ক ! যেন দিক দিগন্তর হইতে শব্দ আসিল,-“পিপাসা পিপাসা” !
মহাত্মা হোসেন শিশুপুত্র আলী আসগরকে কোলে লইয়া জল প্রার্থনা করিতেছেন ! তাঁহার কথা কে শুনে? তিনি দীন নয়নে আকাশপানে চাহিলেন,- আকাশ মেঘশূন্য নির্ষ্মল,- নিতান্তই নির্ম্মল ! তিনি নিজের কষ্ট, -জল পিপাসা অম্লান বদনে সহিতেছেন। পরিজনকে সান্তনা বাক্যে প্রবোধ দিয়াছেন। সকিনা প্রভৃতি বালিকারা জল চাহে না- তাহারা বুঝে, জল দুস্প্রাপ্য। কিন্তু আসগর বুঝে না-সে দুগ্ধপোষ্য শিশু, নিতান্ত অজ্ঞান। অনাহারে জলাভাবে মাতার স্তন্য শুকাইয়া গিয়াছে- শিশু পিপাসায় কাতর।
শহরবানু (হোসেনের স্ত্রী) অনেক যন্ত্রণা নীরবে সহিয়াছেন- আজ আসগরের যাতনা তাঁহার অসহ্য ! তিনি অনেক বিনয় করিয়া হোসেনের কোলে শিশুকে দিয়া জল প্রার্থনা করিতে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন, -“আর কেহ জল চাহে না; কেবল এই শিশুকে একটু জলপান করাইয়া আন। শত্রু যেন ইহাকে নিজ হাতে জল পান করায়,- জলপাত্রটা যেন তোমার হাতে নাই দেয়!!”
মহাত্মা হোসেন স্ত্রীর কাতরতা এবং শিশুর দুরবস্থা দেখিয়া জল প্রার্থনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। কাতরস্বরে বলিলেন, “আমি বিদেশী পথিক, তোমাদের অতিথি, আমার প্রতি যত ইচ্ছা অত্যাচার কর, সহিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু এই শিশু তোমাদের নিকট কোন দোষে দোষী নহে। পিপাসায় ইহা প্রাণ ওন্ঠাগত-একবিন্দু জল দাও ! ইহাতে তোমাদের দয়াধর্ম্মের কিছুমাত্র অপব্যয় হইবে না।” শত্রুগণ কহিল, “বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে, -শীঘ্র কিছু দিয়া বিদায় কর।”
বিপক্ষ হইতে শিশুর প্রতি জলের পরিবর্তে তীর বৃষ্টি হইল! !
“পিয়াস লাগিয়া জলদে সাধিনু
বজর পড়িয়া গেল।”
উপযুক্ত অতিথি-অভ্যর্থনা বটে ! হোসেন শর-বিদ্ধ আসগরকে তাহার জননীর কোলে দিয়া বলিলেন, “আসগর চিরদিনের জন্য তৃপ্ত হইয়াছে ! আর জল জল বলিয়া কাঁদিয়া কাঁদাইবে না ! আর বলিবে না- ‘পিপাসা, পিপাসা’! এই শেষ!”
*
শহরবানু কি দেখিতেছেন? কোলে পিপাসু শর-বিদ্ধ আসগর, সম্মুখে রুধিরাক্ত কলেবর “শহীদ” (সমরশায়ী) আকবর! অমন চাঁদ কোলে লইয়া ধরণী গরবিণী হইয়াছিল-যে আকবর ক্ষতবিক্ষত হইয়া, পিপাসায় কাতর হইয়া মৃত্যুকালে এক বিন্দু জল পায় নাই। শোণিত-ধারায় যেন লেখা আছে “পিপাসা, পিপাসা”! শহীদের মুদ্রিত নয়ন দুটি নীরবের বলে যেন “পিপাসা, পিপাসা”!! দৃশ্য ত এইরূপ মর্ম্মভেদী তাহাতে আমার দর্শক জননী!- আহা!!
যে ফুল ফুটিত প্রাতে,-নিশীথেই ছিন্ন হ’ল,
শিশিরের পরিবর্তে রুধিতে আপ্লুত হ’ল!
আরও দেখিলাম, -মহাত্মা হোসেন সমরশায়ী ! সমরক্ষেত্রে কেবলই পিপাসী শহীদগণ পড়িয়া আছেন। তাঁহাদের শুস্ক কন্ঠ যেন অস্ফুট ভাসায় বলিতেছে “পিপাসা, পিপাসা”! জয়নব (হোসেনের ভাগিনী) মুক্ত কেশে পাগলিনী প্রায় ভ্রাতার নিকট বিদায় চাহিতেছেন। ডাকিয়া, উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিতেছেন, -“ভাই! তোমাকে মরুভূমে ফেলিয়া যাইতেছি ! আসিয়াছিলাম তোমার সঙ্গে,-যাইতেছি তোমাকে ছাড়িয়া ! আসিয়াছিলাম অনেক রত্নে বিভূষিত হইয়া-যাইতেছি শূন্য হৃদয়ে ! তবে এখন শেষ বিদায় দাও ! একটি কথা কও, তবে যাই ! একটিবার চক্ষু মেলিয়া দেখ- আমাদের দুরবস্থা দেখ, তবে যাই !” জয়নবের দুঃখে সমীরণ হায় হায় বলিল, -দূর দূরান্তরে ঐ হায় হায় শব্দ প্রতিধ্বনিত হইল!
*
এখন আর স্বপ্ন নাই-আমি জাগিয়া উঠিয়াছি। দূরে শৃগালের কর্কশ শব্দে শুনিলাম- “পিপাসা, পিপাসা”! একি, আমি পাগল হইলাম নাকি? কেবল “পিপাসা” দেখি কেন। কেবল “পিপাসা” শুনি কেন?
আমার প্রিয়তমের সমাধিস্থানে যাইলাম। বনপথ দিয়া যাইতে শুনিলাম, তরুলতা বলে “পিপাসা, পিপাসা”! পুত্রে মর্ম্মর শব্দে শুনিলাম “পিপাসা, পিপাসা”! প্রিয়তমের গোর হইতে শব্দ আসিতেছিল- “পিপাসা, পিপাসা”! ইহা অতি অসহ্য! প্রিয়তম মৃত্যুকালে জল পায় নাই-চিকিৎসরে নিষেধ ছিল। সুতরাং পিপাসী মরিয়াছে।
আহা! এমন ডাক্তারী কে রচনা করিয়াছেন? রোগীর প্রতি (রোগ বিশেষে) জল-নিষেধ ব্যবস্থা কোন হৃদয়হীন পাষাণের বিধান? যখন রোগীকে বাঁচাইতে না পার, তখন প্রাণ ভরিয়া পিপাসা মিটাইয়া জল পান করিতে দিও। সে সময় ডাক্তারের উপদেশ শুনিও না। নচেৎ আমারই মত আজীবন পিপাসায় দগ্ধ হইবে।
কোন রোগী মৃত্যুর পুর্বদিন বলিয়াছিল, “বাবাজ্বান! তোমারই সোরাহির জল অবশ্যই শীতল হইবে। পিতা তাহার আসন্নকাল জানিয়া স্বহস্তে সোরাহি আনিয়া দিলেন। অন্যান্য মিত্ররুপী শত্রুগণ তাহাকে প্রচুর জল সাধ মিটাইয়া পান করিতে দেয় নাই। ঐ রোগীর আত্মা কি আজ পর্যন্ত কারবালার শহীদদের মত “পিপাসা, পিপাসা” বলিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় না? না; স্বর্গসুখে পিপাসা নাই ! পিপাসা-যে বাঁচিয়া থাকে, -তাহারই! অনন্ত শান্তি নিদ্রায় যে নিদ্রিত হইয়াছে, পিপাসা তাহার নহে! পিপাসা- যে পোড়া স্মৃতি লইয়া জাগিয়া থাকে,-তাহারই !!
“ ” - A.N.M Shafiul Anam
“ ” - Robi User
“ ” - Rabiul Alam Rana
“ ” - Mariya Hossain