logo
0
item(s)

বিষয় লিস্ট

তপন বাগচী এর বাংলাদেশের যাত্রাগান: জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্

প্রথম অধ্যায়

গবেষণার রূপরেখা

 

ক. প্রস্তাবনা

যাত্রা বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি। ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রায় পৌরাণিক কাহিনীর গীতবাদ্য-অভিনয়ের উপস্থাপনা একসময় যাত্রাগান হিসেবে পরিণতি লাভ করে। সময়ের বিবর্তনে যাত্রার-র রূপ বদলে গেছে। বিষয়ে, আঙ্গিকে, উপস্থাপনারীতিতে যাত্রা এখনও সামাজিক বিনোদন, জনজ্ঞাপন, শিক্ষণ এবং প্রভাব বিস্তারের ফলে প্রায়োগিক জনমাধ্যম হিসেবে গ্রহণীয়। আধুনিক নগর-জীবনে যেমন থিয়েটার, গ্রামীণ জনপদে তেমনি যাত্রা এখনও অন্যতম বিনোদন-মাধ্যম হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। স্থূলতা, গ্রাম্যতা ও অশ্লীলতার অভিযোগ এবং নানান নেতিবাচক ধারণা সত্ত্বেও যাত্রার প্রভাব ও বৈভবকে অস্বীকার করা যায় না।

১৮৬০ সালে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১১-১৮৮৮) কৃষ্ণবিষয়ক ঢপ কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি পৌরাণিক পালা রচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রার যে গতিসঞ্চার করেন, চারণকবি বরিশালের মুকুন্দ দাসের (১৮৮৭-১৯৩৪) হাতে তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জাগরণী মন্ত্র। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রজেন্দ্রকুমার দের (১৯০৭-১৯৭৬) হাতে যাত্রা বিকশিত হয়ে পৌরাণিক পালার পাশাপাশি ঐতিহাসিক, লোককাহিনীভিত্তিক ও সামাজিক পালায়। পেশাদার যাত্রাদলের আবির্ভাবে যাত্রা হয়ে ওঠে গ্রাহ্য শিল্পমাধ্যম। ভাষাপ্রয়োগে, সংলাপ-প্রক্ষেপণে, মঞ্চসজ্জায় ও পরিবেশনরীতির নিজস্বতায় যাত্রা আধুনিক থিয়েটার বা নাটক থেকে স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। বহুমুখী ইলেকট্রনিক মাধ্যমের প্রবল প্রতাপের এই প্রযুক্তিযুগেও বাংলাদেশের শতাধিক যাত্রাদলের কর্মকাণ্ড যাত্রাশিল্পের গুরুত্বকেই প্রমাণ করে। ১৮৬০ সাল থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে যাত্রাশিল্পচর্চার ধারা অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রায় অনালোচিত ও অবহেলিত একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি ফেরানো যায়।

যাত্রার উদ্ভব হয়েছে অতি প্রাচীনকালে। কিন্তু নির্ধারিত পালারচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে ঢাকায় তথা বাংলাদেশে এর উদ্বোধন হয় ১৮৬০ সালে। তাই ১৮৬০ সালকে বাংলাদেশে যাত্রা মঞ্চায়নের আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যাত্রার ইতিহাস এত দীর্ঘ এবং প্রায়োগিক সাফল্য এত গৌরবময় হলেও এ-বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা ও গবেষণা হয়নি। তবে ১৮৮২ সালে ঢাকার গবেষক নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় (১৮৫২-১৯১০) সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে The Yatras or The Popular Dramas of Bengal শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অবিভক্ত বঙ্গদেশে যাত্রা বিষয়ে প্রণালীবদ্ধ গবেষণার এটিই প্রথম উদ্যোগ। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে কিছু গবেষণা পরিচালিত হলেও বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যাত্রা বিষয়ে আর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হয়নি। এই বিবেচনায় বর্তমান গবেষণাই এ দেশের প্রথম প্রচেষ্টা। এ-গবেষণায় যাত্রার ইতিহাস, যাত্রার বিবর্তন, যাত্রাশিল্পের বর্তমান অবস্থা, জনমাধ্যম হিসেবে এর গুরুত্ব, সামাজিক প্রভাব প্রভৃতি বিষয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে।

অভিসন্দর্ভের প্রথম অধ্যায়ে গবেষণার রূপরেখা শিরোনামে গবেষণার প্রস্তাবনা, গবেষণা-পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণার পর্যালোচনা স্থান পেয়েছে। মানববিদ্যার গবেষণায় সাধারণত গবেষণা-পদ্ধতি উল্লেখ করা হয় না। বক্ষ্যমাণ গবেষণায় মানববিদ্যার পাশাপাশি সমাজবিদ্যার প্রয়োগ রয়েছে। তাই গবেষণা-পদ্ধতি উল্লেখ করাকে অপরিহার্য মনে করা হয়েছে। এ-ছাড়া ইতঃপূর্বে যাত্রা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রায় সকল গবেষণাকর্মের পর্যালোচনা করে বর্তমান গবেষণার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাংলায় যাত্রাগানের উদ্ভব বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেক প্রচলিত মতকে যাচাই-বাছাই করে নতুন মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙালির প্রাণের উৎসব যাত্রার উদ্ভব ও সূচনালগ্নের ইতিহাস এখানে বিবৃত হয়েছে। ঋগ্বেদের সূক্ত থেকে অভিনয়-চেতনার উন্মেষকালের অনুসন্ধান করা হয়েছে। যাত্রা নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের প্রায় সকলের পর্যবেক্ষণ থেকে যাত্রার উদ্ভবকাল নির্ণয় করা হয়েছে। উদ্ভবকাল সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষকের অভিমত একটি সারণিতে আবদ্ধ করে একনজরে দেখানো হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পের ক্রমবিকাশ শিরোনামে আলোচনা করতে গিয়ে ১৮৬০ সালকে সূচনাবিন্দু ধরা হয়েছে এ-কারণে যে, এ বছর পূর্ববঙ্গে তথা ঢাকায় আনুষ্ঠানিক যাত্রানুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায় এবং অভিনীত পালার মুদ্রিত কপি পাওয়া যায়। সেখান থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ বছর পর্যন্ত সময়কালে যাত্রার ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলাদেশের যাত্রাপালা ও পালাকার শিরোনামে আলোচনার পর্যায়ে যাত্রাপালার শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চে অভিনীত পৌরাণিক বা ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক পালা, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পালা, কাল্পনিক ও লোককাহিনীভিত্তিক পালা, সামাজিক পালা এবং জীবনী পালার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এ থেকে আমাদের দেশে অভিনীত যাত্রাপালার বিষয় ও আধেয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ নাটক সেন্সর কমিটি যে সকল যাত্রাপালার ছাড়পত্র প্রদান করেছিল এবং সে সকল অংশ সেন্সর করেছিল তা নিয়ে সম্যক আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে পালাকারদের পরিচিতি ও মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে এ অধ্যায়ে।

পঞ্চম অধ্যায়ে বাংলাদেশে যাত্রার বর্তমান অবস্থার শিরোনামে যাত্রাদল ও সংগঠনের অবস্থা, যাত্রাপালা ও পালাকারদের অবস্থা, যাত্রা সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যাত্রাদল ও সংগঠনের অবস্থা নিরূপণ করতে ক্ষিত্রসমীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। যাত্রাপালা ও পালাকারদের অবস্থা জানা গেছে যাত্রা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। বিভিন্ন গ্রন্থ ও সংকলনে প্রাপ্ত তথ্য থেকে যাত্রা সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। যাত্রাশিল্পের ওপর জারীকৃত নিষেধাজ্ঞা এবং তা প্রত্যাহারের পরিপত্র উদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় মনোভাব যাচাই করা হয়েছে। যাত্রা সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিরূপণও এ অধ্যায়ের অন্বিষ্ট।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে জনমাধ্যম হিসেবে যাত্রার সামাজিক প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে। যাত্রা গণমাধ্যম বা জনমাধ্যম কিনা প্রথমে সেই প্রশ্নের মীমাংসা করা হয়েছে। পরে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে যাত্রার প্রভাবকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা ছাড়াও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) জীবনে ও সাহিত্যকর্মে যাত্রার প্রভাব অনুসন্ধান করা হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে চারণকবি মুকুন্দ দাসের যাত্রার প্রভাবও এখানে আলোচিত হয়েছে। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত যাত্রাপালার রচনা ও মঞ্চায়নের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা এ-অধ্যায়ে রয়েছে। বেতার-টেলিভিশনে যাত্রা-সম্প্রচারের তথ্যও এখানে আলোচিত হয়েছে।

উপসংহার অংশে রয়েছে সমগ্র আলোচনার সমন্বিত রূপের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এ ছাড়া পরিশিষ্ট অংশে বাংলাদেশ নাটক সেন্সর কমিটির ছাড়পত্রপ্রাপ্ত যাত্রাপালার তালিকা, বাংলাদেশের যাত্রাদলের প্রতিষ্ঠাকালভিত্তিক তালিকা, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত যাত্রাপালার তালিকা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া যাত্রানুষ্ঠানের কিছু আলোকচিত্র এখানে সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্ট বই

পাঠকের মতামত
রিভিউ লিখুন
রিভিউ অথবা রেটিং করার জন্য লগইন করুন!