টেলিফোন
কোম্পানির দূরপাঠ-ভুলপাঠ!
পাবর্ত্য তিন জেলা নিয়ে সমতলের মানুষের মনোজগতে
কল্পনাপ্রসূত একটি কাঠামো তৈরি করা আছে। সেই কাঠামো আবার ব্যক্তি, গোষ্ঠীর নিজস্ব কল্পনার
ওপর নির্ভরশীল। কল্পনার তুলিতে যার যেমন খুশি, পার্বত্য জেলা নিয়ে তেমন ভাবনাই সবার।
রাষ্ট্র নিজেও ভেবেছে নিজের মতো করে। যখন যে রাজনৈতিক দল বা সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন
তারা নিজেদের আদর্শের রঙে রাঙাতে চেয়েছে পার্বত্য তিন জেলা— বান্দরবান, রাঙামাটি এবং
খাগড়াছড়িকে। পাহাড়ের মানুষের নিজস্ব ভাবনা তাদের সেই কল্পনার ক্যানভাসে জায়গা পায়নি।
যে কারণে রাষ্ট্রের সঙ্গে, সমতলের মানুষের সঙ্গে পাহাড়ের ভূমিপুত্র-কন্যাদের এখনো দূরত্ব
কমেনি। বরং নতুন নতুন ইস্যুতে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্র নিজের মতো করে ভেবেছে বলেই
তার অন্যান্য সংগঠন এবং সমতলের নাগরিকেরা পার্বত্য তিন জেলা’র কল্পনাপ্রসূত ধারণা আমমানুষের
সামনে নিয়ে আসার দুঃসাহস দেখিয়েছে। সেই কাজে গণমাধ্যমও পিছিয়ে থাকেনি। বরং এগিয়েই আছে।
কারণ গণমাধ্যমগুলোও তাদের নিজেদের ধারণা ও বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়েই পার্বত্যঞ্চলের
টুকরো টুকরো ছবি পাঠক, দর্শকের কাছে উপস্থাপন করছে। সার্বিকভাবে কল্পনার এই ফ্যান্টাসি
আম মানুষকেও পার্বত্য তিন জেলা নিয়ে নিজ নিজ কল্পনার ছবি আঁকতে শেখাচ্ছে। সর্বশেষ সেই
আঁকা শেখানোর দায়িত্বটি যেমন নিলো গ্রামীণফোন। গ্রামীণফোন ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের শক্তিমত্তার
কথা বলেছে অনলাইন স্কুলের গল্পে। পাঁচ কোটি নেটওয়ার্কে বহুদূর যাবার স্বপ্ন দেখাতেই
অনলাইন স্কুল গল্পের অবতারণা।
ষাট সেকেন্ডের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনটি এগিয়ে গেছে
পাহাড়ি শিশু শেখরকে অবলম্বন করে। শেখরের বয়স কতো হবে? পাহাড়ি অধিবাসীদের যতজনের সঙ্গে
কথা বলেছি, তাদের বেশির ভাগ বলেছেন— পাঁচ বছরের শেখরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে,
পাহাড়ে শেখরের বয়সী কেউ এভাবে এত দূরে বাবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যায় না। ফসলের
মাঠে ব্যস্ত বাবার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়ার গল্প সমতলের সঙ্গে অনেকটাই বাস্তব ঘনিষ্ঠ।
পাহাড়ের জন্য নয়। কারণ পাহাড়ে জুম চাষের সঙ্গে জড়িত যারা, তারা জুমিয়া পরিবার বলে পরিচিত।
এদের যাপিত জীবনের ঢঙ আরবের বেদুঈনদের মতো। তাদের স্থায়ী বসতের অভ্যাস নাই। জুম চাষের
জন্য তারা পুরো পরিবারসহ ঘুরে বেড়ায়। এ কারণে জুমাইয়া পরিবারের শিশুরা পাহাড়ের প্রাথমিক
স্কুলগুলো থেকে ঝরে পরতো বেশি। এখন পাহাড়ে পাহাড়ে আবাসিক স্কুল করে দেয়ায়, ঝরে পড়ার
হার অনেকটা কমেছে। যেহেতু পরিবার নিয়ে তারা একসঙ্গে জুম চাষের এলাকাতেই থাকে, সেহেতু
দুপুরের খাবার নিয়ে দূরে কোথাও পৌঁছে দেয়ার বাস্তবতা নেই প্রথমত। দ্বিতীয়ত হলো যারা
তারপরও কিছুটা দূরে যান চাষের প্রয়োজনে তারা সকালে দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়েই বের হোন।
তৃতীয়ত-তারপরও যদি কেউ খাবার না নিয়েই জুম চাষে চলে যান, তাহলেও খাবার পৌঁছে দেয়ার
দায়িত্বটি শেখরের বয়সী কারো কাঁধে তুলে দেয়া হয় না। কাজটি ওর চেয়ে বয়সে বেশ বড় কেউ
করে থাকে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ছোট্ট শেখর তার বাবার কাছে খাবার নিয়ে পৌঁছানোর আগেই
পৃথিবী তার অক্ষের উপর অর্ধেক চক্কর দিয়ে দেয়। পাহাড়ি জনপদের মানুষেরা বলছেন, এতটা
দূরত্বে জুমিয়া পরিবারেরা বসত গড়ে না। জুম চাষ এলাকার কাছে বসত বাঁধে বলেই শেখর বয়সী
শিশুরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে জুম চাষে যোগ দেয়। জুম ফসলের মাঠে তাদের দেখা যায়। বিজ্ঞাপনটি
যে তথ্যগত ভুলে ভরা তার আরেকটি প্রমাণ, বিজ্ঞাপনে জানানো হচ্ছে, ভোরের পত্রিকাটি এখানে
পৌঁছতে পৌঁছতে দিন পার হয়ে যায়। এই তথ্যটি এখন পুরো এই ভূখণ্ডের জন্যই অসত্য। যোগাযোগ
অবকাঠামোর উন্নতি এবং সংবাদপত্রের একাধিক সংস্করণের উদ্যোগের কারণে, পাবর্ত্যসহ যেকোনো
জেলাতেই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সেখানে পত্রিকা পৌঁছে যায়। উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রামের
বেলাতেও তথ্য একই। চর বা পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে সংবাদপত্রের পাঠক আছে সেখানে পত্রিকা
পৌঁছতে না হয় বড় জোড় ঘণ্টা দুইয়েক দেরি হয়। সুতরাং এই বিজ্ঞাপনটির মাধ্যমে গ্রামীণফোন
ও তার দুই সহযোগী জাগো এবং অগ্নি (অনলাইন সিস্টেম পার্টনার) দর্শকদের ভুল তথ্য জানাচ্ছে।
পার্বত্য তিন জেলার এই মুহূর্তের বাস্তবতা সম্পর্কে যে দর্শকরা অবগত নন, তারা টেলিভিশনে
বহুল প্রচারিত এই বিজ্ঞাপন থেকে পার্বত্যঞ্চলের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অসত্য তথ্য পাচ্ছেন।
“ ” - Bookworm