logo
0
item(s)

বিষয় লিস্ট

তুষার আবদুল্লাহ এর বিজ্ঞাপন ব্যবচ্ছেদ

বিজ্ঞাপন ব্যবচ্ছেদ
এক নজরে

মোট পাতা: 203

বিষয়: প্রবন্ধ

টেলিফোন কোম্পানির দূরপাঠ-ভুলপাঠ!

 

 

 

পাবর্ত্য তিন জেলা নিয়ে সমতলের মানুষের মনোজগতে কল্পনাপ্রসূত একটি কাঠামো তৈরি করা আছে। সেই কাঠামো আবার ব্যক্তি, গোষ্ঠীর নিজস্ব কল্পনার ওপর নির্ভরশীল। কল্পনার তুলিতে যার যেমন খুশি, পার্বত্য জেলা নিয়ে তেমন ভাবনাই সবার। রাষ্ট্র নিজেও ভেবেছে নিজের মতো করে। যখন যে রাজনৈতিক দল বা সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা নিজেদের আদর্শের রঙে রাঙাতে চেয়েছে পার্বত্য তিন জেলা— বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িকে। পাহাড়ের মানুষের নিজস্ব ভাবনা তাদের সেই কল্পনার ক্যানভাসে জায়গা পায়নি। যে কারণে রাষ্ট্রের সঙ্গে, সমতলের মানুষের সঙ্গে পাহাড়ের ভূমিপুত্র-কন্যাদের এখনো দূরত্ব কমেনি। বরং নতুন নতুন ইস্যুতে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্র নিজের মতো করে ভেবেছে বলেই তার অন্যান্য সংগঠন এবং সমতলের নাগরিকেরা পার্বত্য তিন জেলা’র কল্পনাপ্রসূত ধারণা আমমানুষের সামনে নিয়ে আসার দুঃসাহস দেখিয়েছে। সেই কাজে গণমাধ্যমও পিছিয়ে থাকেনি। বরং এগিয়েই আছে। কারণ গণমাধ্যমগুলোও তাদের নিজেদের ধারণা ও বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়েই পার্বত্যঞ্চলের টুকরো টুকরো ছবি পাঠক, দর্শকের কাছে উপস্থাপন করছে। সার্বিকভাবে কল্পনার এই ফ্যান্টাসি আম মানুষকেও পার্বত্য তিন জেলা নিয়ে নিজ নিজ কল্পনার ছবি আঁকতে শেখাচ্ছে। সর্বশেষ সেই আঁকা শেখানোর দায়িত্বটি যেমন নিলো গ্রামীণফোন। গ্রামীণফোন ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের শক্তিমত্তার কথা বলেছে অনলাইন স্কুলের গল্পে। পাঁচ কোটি নেটওয়ার্কে বহুদূর যাবার স্বপ্ন দেখাতেই অনলাইন স্কুল গল্পের অবতারণা।

ষাট সেকেন্ডের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনটি এগিয়ে গেছে পাহাড়ি শিশু শেখরকে অবলম্বন করে। শেখরের বয়স কতো হবে? পাহাড়ি অধিবাসীদের যতজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের বেশির ভাগ বলেছেন— পাঁচ বছরের শেখরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, পাহাড়ে শেখরের বয়সী কেউ এভাবে এত দূরে বাবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যায় না। ফসলের মাঠে ব্যস্ত বাবার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়ার গল্প সমতলের সঙ্গে অনেকটাই বাস্তব ঘনিষ্ঠ। পাহাড়ের জন্য নয়। কারণ পাহাড়ে জুম চাষের সঙ্গে জড়িত যারা, তারা জুমিয়া পরিবার বলে পরিচিত। এদের যাপিত জীবনের ঢঙ আরবের বেদুঈনদের মতো। তাদের স্থায়ী বসতের অভ্যাস নাই। জুম চাষের জন্য তারা পুরো পরিবারসহ ঘুরে বেড়ায়। এ কারণে জুমাইয়া পরিবারের শিশুরা পাহাড়ের প্রাথমিক স্কুলগুলো থেকে ঝরে পরতো বেশি। এখন পাহাড়ে পাহাড়ে আবাসিক স্কুল করে দেয়ায়, ঝরে পড়ার হার অনেকটা কমেছে। যেহেতু পরিবার নিয়ে তারা একসঙ্গে জুম চাষের এলাকাতেই থাকে, সেহেতু দুপুরের খাবার নিয়ে দূরে কোথাও পৌঁছে দেয়ার বাস্তবতা নেই প্রথমত। দ্বিতীয়ত হলো যারা তারপরও কিছুটা দূরে যান চাষের প্রয়োজনে তারা সকালে দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়েই বের হোন। তৃতীয়ত-তারপরও যদি কেউ খাবার না নিয়েই জুম চাষে চলে যান, তাহলেও খাবার পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটি শেখরের বয়সী কারো কাঁধে তুলে দেয়া হয় না। কাজটি ওর চেয়ে বয়সে বেশ বড় কেউ করে থাকে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ছোট্ট শেখর তার বাবার কাছে খাবার নিয়ে পৌঁছানোর আগেই পৃথিবী তার অক্ষের উপর অর্ধেক চক্কর দিয়ে দেয়। পাহাড়ি জনপদের মানুষেরা বলছেন, এতটা দূরত্বে জুমিয়া পরিবারেরা বসত গড়ে না। জুম চাষ এলাকার কাছে বসত বাঁধে বলেই শেখর বয়সী শিশুরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে জুম চাষে যোগ দেয়। জুম ফসলের মাঠে তাদের দেখা যায়। বিজ্ঞাপনটি যে তথ্যগত ভুলে ভরা তার আরেকটি প্রমাণ, বিজ্ঞাপনে জানানো হচ্ছে, ভোরের পত্রিকাটি এখানে পৌঁছতে পৌঁছতে দিন পার হয়ে যায়। এই তথ্যটি এখন পুরো এই ভূখণ্ডের জন্যই অসত্য। যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নতি এবং সংবাদপত্রের একাধিক সংস্করণের উদ্যোগের কারণে, পাবর্ত্যসহ যেকোনো জেলাতেই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সেখানে পত্রিকা পৌঁছে যায়। উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রামের বেলাতেও তথ্য একই। চর বা পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে সংবাদপত্রের পাঠক আছে সেখানে পত্রিকা পৌঁছতে না হয় বড় জোড় ঘণ্টা দুইয়েক দেরি হয়। সুতরাং এই বিজ্ঞাপনটির মাধ্যমে গ্রামীণফোন ও তার দুই সহযোগী জাগো এবং অগ্নি (অনলাইন সিস্টেম পার্টনার) দর্শকদের ভুল তথ্য জানাচ্ছে। পার্বত্য তিন জেলার এই মুহূর্তের বাস্তবতা সম্পর্কে যে দর্শকরা অবগত নন, তারা টেলিভিশনে বহুল প্রচারিত এই বিজ্ঞাপন থেকে পার্বত্যঞ্চলের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অসত্য তথ্য পাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন জানাচ্ছে— ‘সকালের সোনালি আলো চুপটি করে পাতার ফাঁক গলে সরাসরি শেখরের ঘরে পৌঁছে যায়, আর অনলাইন স্কুল একদম শেখরের দোরগোড়ায়’। এই অংশটুকু থেকে দর্শক দুটি ধারণা পেতে পারেন। এক. সত্যি পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন স্কুল। যেখানে পাহাড়ি শিশুরা অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা পাচ্ছে। পাহাড়ি শিশুদের জন্য যে স্কুলগুলো আছে সেখানে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার প্রযুক্তিও সহজলভ্য হয়েছে বলেই ধারণা পাবেন দর্শক। দুই. গ্রামীনফোন, জাগো এবং অগ্নি মিলে পাহাড়ে অনলাইন স্কুল খোলার প্রকল্প নিয়েছে। এই দুটি ধারণার বিষয়েই পাহাড়ি জনপদের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির পাহাড়ি-বাঙালি সবাই বিজ্ঞাপনটি দেখেছেন। তারা ভেবেছেন এটা নিছকই একটি গল্প। পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্য ব্যবহার করে নিজেদের নেটওয়ার্কের পক্ষে বাদ্য বাজাতে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা হয়েছে। বান্দরবানে কথা বলে দেখা গেলো— সেখানেও সর্বজনতা অনলাইন স্কুলটির কথা জানেন না। গণমাধ্যম কর্মীরা জানেন, কারণ বিজ্ঞাপন তৈরির সময় বা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কারাপাড়ার। একটি অনলাইন স্কুল চালুর সময় গ্রামীণ, অগ্নি এবং জাগো তাদের সেখানে নিয়ে যায়। বলে রাখা ভালো জাগোর এই অনলাইন স্কুলগুলোর আর্থিক ও কাঠামোগত পৃষ্ঠপোষকতা গ্রামীণফোনের। ইন্টারনেট সহায়তার কাজটি করে অগ্নি সিস্টেম। স্কুল পরিচালনার পুরো দায়িত্ব জাগো ফাউন্ডেশনের। তারা সারা দেশে ২০১৪ পর্যন্ত ১০টি অনলাইন স্কুল খোলা চালু করেছে। পাহাড়ি এলাকায় খোলা হয়েছে একটি স্কুল। বান্দরবানের স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের বক্তব্য হচ্ছে— বাস্তবতা থেকে অনলাইন স্কুলের বিজ্ঞাপনটির যোজন যোজন দূরত্ব। জাগো ফাউন্ডেশন পরিচালিত অনলাইন স্কুলে পাহাড়ি, বাঙালি শিশুরা একসঙ্গে পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটিতে শুধু পাহাড়ি শিশুদের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। ফলে পাহাড়ে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যকার ঐক্যের বাস্তবতাকে অস্বীকার বা আড়াল করা হয়েছে। তাদের মতে, পাহাড়ি শিশুরা নিজ মার্তৃভাষার পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি শেখে। প্রথমত তারা বাংলা শেখে। কোনো কোনো পরিবার তাদের শিশুদের ই্ংরেজিও শেখায়। কিন্তু বিজ্ঞাপনটি দেখে দর্শকরা ভুল তথ্য জানবেন এভাবে যে, পাহাড়ি শিশুরা বুঝি ই্ংরেড়ি ভাষাতেই পড়ালেখা শুরু করে। বিজ্ঞাপনে দেখা যায় শেখর (ওর বয়স সাড়ে পাঁচ এবং পুরো নাম শেখর লাল) যখন বলছে— এ ফর । তখন ওর দাদি মা উচ্চারণ করছেন— অ্যাপেল। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা এই দৃশ্যের বাস্তবতা মেলাতে পারছেন না। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী, আদিবাসী নেতা ও নৃতত্ত্ব বিশ্লেষকদের মতে, এখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আবেগকে ব্ল্যাকমেইলিং করা হয়েছে। তাদের মতে, বিজ্ঞাপনে অনলাইন শিক্ষিকাকে যেভাবে হিজাব পরিহিত অবস্থায় দেখানো হয়েছে, সেটি সমাজের স্বাভাবিক চিত্র নয়। হিজাব পরার প্রবণতা বেড়েছে স্বীকার করে নিলেও, বলতে হয়— এর মধ্য দিয়ে একটি ধর্মের কতিপয় অংশের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপনে সমাজের বিশেষ অংশের প্রতিনিধিত্ব বা উদাহরণকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নন দর্শকরা। 

সংশ্লিষ্ট বই

পাঠকের মতামত
  • Rating Star

    “ ” - Bookworm

রিভিউ লিখুন
রিভিউ অথবা রেটিং করার জন্য লগইন করুন!