নোবেলের শহর প্রসঙ্গে
স্থপতি কাজী এম
আরিফ, স্থপতি তরিকুল ইসলাম লাভলু, এনায়েত কবীর, এম সাঈদ হাসান আর আমি, এই নিয়ে আমাদের
পঞ্চপর্যটকের দল। ২০১১ সালের মধ্য এপ্রিলে পোল্যান্ড যাওয়ার পথে মাত্র ৩ রাতের জন্যে
সুইডেনের রাজধানী শহর স্টকহোম বেড়াতে গিয়েছিলাম আমাদের পঞ্চপর্যটকের সাথে। মাত্র তিন
দিন একটি শহরকে বোঝার জন্যে মোটেও বেশি সময় নয়। তার পরও চেষ্টা করেছি, এই শহরের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দেখার, তার ইতিহাস জানার। স্থানীয় মানুষদের সাথে মেশার সুযোগ
হয়নি, তবে সুইডেনে বসবাসরত বাঙালিদের কাছ থেকে শুনেছি সুইডিশদের গল্প। সেসব নিয়েই লিখেছি
এই নোবেলের শহর।
আমার অন্য বইগুলোতে
নানা মাধ্যম থেকে ধার করে ছবি ব্যবহার করলেও এ বইটিতে তা একেবারেই করা হয়নি। ছবির ক্রেডিট
আলাদাভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার নিজের ছাড়াও পঞ্চপর্যটকদের দুজন‒বিশেষ করে স্থপতি তরিকুল ইসলাম ও স্থপতি কাজী এম আরিফ-এর তোলা ছবিও ব্যবহার
করেছি। ধন্যবাদ অন্যপ্রকাশ-এর প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলামকেও, কারণ ছবিগুলো দেখার
পর বইটি তিনি চার রঙ-এ ছাপার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
শাকুর মজিদ
১৩
ডিসেম্বর ২০১৩
shakoormajid@yahoo.com
রোড টু স্টকহোম
বাংলাদেশ থেকে
সোজাসুজি সুইডেনে উড়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। বেশ কয়েক জায়গায় প্লেন বদল করতে হয়। আমরা
নিয়েছি মধ্যপ্রাচ্যের রুট। ঢাকা থেকে দুবাই, দুবাই হয়ে ইউরোপের বড় হাব ফ্রাঙ্কফোর্ট,
সেখান থেকে সুইডেনের রাজধানী শহর স্টকহোম।
এমিরেটস এয়ারের
ঢাউস উড়োজাহাজটা যখন দুবাই বিমানবন্দরের রানওয়ে ছেড়ে ওপরে উঠতে থাকে, তখন আমরা নড়েচড়ে
বসি। আমাদের ক্যামেরা যুগল সচল হয়ে ওঠে। দুবাই-এর আকাশছোঁয়া সব আধুনিক ভবনগুলোকে আরেকবার
দেখি। এত ওপর থেকে আধুনিক স্থাপত্য নকশা আর পেট্রোডলারের তেজে নির্মিত দুবাইয়ের এই
ভবনগুলোকে বরফির টুকরোর মতোই মনে হয়।
একসময় আমাদের বিমানটি
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমাকে ছাড়িয়ে ইউরোপের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। এমিরেটস এয়ারের এই
উড়োজাহাজটিতে আসনসংখ্যার তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা খুব একটা বেশি না। অধিকাংশ আসনই ফাঁকা
পড়ে আছে। যাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগই সাদা চামড়ার মানুষ। আমরা বাংলাদেশি পঞ্চপর্যটকের
দল শুধু বাদামি চামড়ার। দুবাই থেকে ইউরোপমুখী প্লেনগুলোতে এটাই খুব স্বাভাবিক অবস্থা।
এ নিয়ে একসময় মন খারাপ হতো, এখন আর হয় না।
সিটে স্থির কতগুলো
দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্লান্তি আসে। একমাত্র ভরসা সিটের সামনে লাগানো দশ ইঞ্চির এলসিডি
মনিটর। নানা রকমের গান-বাজনা, ছবি দেখার সুযোগ আছে। আমার চোখ স্থির হয়ে আছে বিমানের
জিপিএস-এর পর্দায়। দেখতে থাকি আমাদের বিমানের অবস্থান।
দুবাই থেকে কাল
সন্ধ্যায় এসে নেমেছি জার্মানির ফ্রাঙ্কফোর্ট বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশন চেক আউট করে এয়ারপোর্টের
কাছেই একটা হোটেলে কোনো মতে রাত কাটিয়ে ভোররাতে ফিরে এসেছি ফ্রাঙ্কফোর্টের বিমানবন্দরে।
সকাল সাড়ে সাতটায় ছিল আমাদের ফ্লাইট। ফ্রাঙ্কফোর্ট থেকে স্টকহোমের দূরত্ব প্রায় তিন
ঘণ্টা।
গত দুই দিন ধরে
ওড়াউড়ির মধ্যেই আছি। যতটা সময় স্থলে ছিলাম, তার বেশি অন্তরীক্ষে। কিছুক্ষণ পরে স্টকহোমের
স্থলে ৩ দিন থাকার পর আবার জলের ওপর ভাসা হবে প্রায় একদিন।
তিন সপ্তাহের এই
ইউরোপ ট্যুরটা এভাবেই ফড়িংয়ের মতো ওড়াউড়ির মধ্যে দিয়েই যাবে।
একবার এই উড়োজাহাজের
জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখি রাশি রাশি মেঘপুঞ্জের ওপর দিয়ে আমরা ভেসে চলেছি। একসময় দেখতে
পাই ঘন কুয়াশার জাল ঘিরে ধরে উড়োজাহাজের ঢাউস জানালাটা। বুঝতে পারি মাটি থেকে আমাদের
উচ্চতা কমতে শুরু করেছে। ঘনকুয়াশার মেঘ ফুঁড়ে যখন আমাদের এই উড়োজাহাজটি আরো একটু নিচের
দিকে নেমে এসেছে তখন আমাদের ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে বহুদূরের মানববসতি আর ঘরবাড়ি,
চুলের ফিতার মতো সর্পিল নদী, মাথার সিঁথির মতো সড়কপথ। বুঝতে পারি ছোট-বড় ১৪টি দ্বীপ
নিয়ে গড়ে ওঠা সুইডেনের রাজধানী শহর থেকে খুব একটা বেশি দূরত্বে আর নেই।
সকাল সাড়ে নয়টার
দিকে ফ্রাঙ্কফোর্ট থেকে আসা আমাদের বিমানটি এসে নামে সুইডেনের রাজধানী শহর স্টকহোমের
অরল্যান্ড বিমানবন্দরে। যেহেতু এটা একটি আন্তইউরোপীয় ফ্লাইট, সেহেতু বিমানবন্দরেও খুব
বেশি ঝামেলার কিছু ঘটে না। আমরা খুব দ্রুত বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দেখি সুইডেনের ঝকঝকে
আকাশ।
বিমানবন্দর থেকে
বেরিয়েই আমাদের লোক পেয়ে যাই। সাজ্জাদ ওখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা মূলত পোল্যান্ড
যাওয়ার জন্যে এসেছি। মাঝখানে ৩ রাতের জন্যে সুইডেনের রাজধানী শহর এই স্টকহোমে আমাদের
একটা বাড়তি ট্রিপ, মূলত রিনির জন্যে।
রিনি লাভলু ভাইয়ের
ভাতিজি, বড় ভাইয়ের মেয়ে। ছোটবেলা কোলেপিঠে করে তাকে বড় করেছেন। মেয়েটি এখন বিয়ে করে
স্বামী নিয়ে সুইডেন থাকে। তার চাচা [লাভলু ভাই] বন্ধুদের নিয়ে পাশের দেশ থেকে ঘুরে
চলে যাবেন, এটা হবে না। তাকে দেখে যেতেই হবে।
আমাদেরও বাড়তি
লাভ। পোল্যান্ড দেখতে এসে তার আশপাশের দু-একটা দেশও যদি দেখে ফেলা যায়, খারাপ কী!
এই সুইডেন নিয়ে
আমারও অনেক কৌতূহল। স্ক্যান্ডানেভিয়ান দেশগুলো ইউরোপ থেকে একটু আলাদা। দীর্ঘদিন, দীর্ঘ
রাত, অতি শীত, ফ্রি সেক্স, কত কিছুই শোনা হয়েছে এ দেশ নিয়ে। তার ওপর নোবেল পুরস্কারের
প্রণেতা আলফ্রেড নোবেলের শহর এই স্টকহোম। সব মিলিয়ে একটু বাড়তি শিহরণ বোধ করতে থাকি
আমি।
আমি লাভলু ভাইকে
বলি, নোবেল সাহেবের বাড়িটা দেখা যাবে তো?
‘হবে।’ লাভলু ভাই
আশ্বস্ত করেন। তাঁর ট্যুর প্ল্যানিংয়ে আমার অগাধ আস্থা।
তিন দিন এ শহরে
থেকে আমরা দেখবো আলফ্রেড নোবেলের শহর স্টকহোম, তারপর বাল্টিক আর কৃঞ্চসাগর পাড়ি দিয়ে
চলে যাব পোল্যান্ডের নৌবন্দর গিদাইনসক। সেখানে দেখা হবে লেস ওয়ালেসার সাথে।