এক
০৪ আগস্ট,
০৬-১০ ঘণ্টা। ভোরের সোনালি সূর্য রশ্মি জাপানের সবুজ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। হিরোশিমার
এক ছোট্ট পল্লী গ্রাম। নাম নাকাতাকিদ। জাপানে মুসলিমদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। কিন্তু
নাকাতাকিদের বেলায় ব্যতিক্রম। এই একটি গ্রামই আছে চার চারটি মুসলিম পরিবার। ফজরের নামাজ
শেষে জানালার পাশে বসে কোমল সুরেলা কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করছে এক যুবক। কি পবিত্র
লাগছে তাকে! জাপানের আবহাওয়া শতভাগ বিশুদ্ধ হওয়ায় এ কদিনেই চেহারায় লাবণ্য এসেছে
ওর। সকালের প্রথম সূর্য রশ্মি হালকা কালো দাড়িতে হীরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশি
এ যুবক মৃদুভাষী। মুখ দেখলে বোঝার উপায় নেই, কোন ধাতুতে গড়া। পুরো নাম আবু আবদেল
মিরাজ। ডাক নাম মিরাজ। তবে একটি বিষয়ে সে অতিমাত্রায় দুর্বল। সে অতি সহজেই মানুষকে
বিশ্বাস করে ফেলে। যে কারণে শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিগত তিন বছরেই দু-দুটি
মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। ভুল দুটি সাধারণ ভুল নয়। সারা জীবন অনুতপ্ত করলেও আল্লাহর
দরবারে ক্ষমা পাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে! তবে এমন ভুলের কারণে নতুন করে শিক্ষাও
পেয়েছে বলা যায়। সে গত কয়েকদিন থেকে ভাবছে দেশে চলে যাবে। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে
প্রায় এক মাস হলো মালয়েশিয়ান একটি তাবলিগ টিমের সাথে জাপান এসেছে। প্রথমে টোকিও
পরে হিরোশিমা। দলের কনিষ্ঠ সদস্য সে। বর্তমানে হিরোশিমার একটি তাবলিগ টিমের গেস্ট
হয়ে সময় পার করছে দলটি। এখানকার জামাত সদস্যরা তাদের সাদরে আপ্যায়ন করেছে।
পরবর্তী যাত্রার অপেক্ষায় আছে।
মালয়েশিয়ান তাবলিগ দলের সাথে জাপানের আরো কিছু সদস্যকে নিয়ে কাজাকিস্তানে যাওয়ার
পরিকল্পনা ছিল। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছে সে। সাবেক সোভিয়েত ব্লকের
কোনো দেশে যাওয়ার বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ানদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। তবে
মিরাজের চিন্তাধারা আলাদা। দেশটির নাম শুনে আগ্রহ হওয়ার কারণ সে দেশের মুসলিম
সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্মুখ জ্ঞান অর্জন। সুযোগ পেলে টার্কিতে ঢোকার
চেষ্টা করবে। ইস্তাম্বুল আর আনকারার জাদুঘরে বিজ্ঞানে মুসলমানদের প্রাথমিক
অগ্রযাত্রার যেসব নিদর্শন সংরক্ষিত আছে তা স্বচক্ষে দেখা। এ ছাড়া সুলতান
সুলেয়মানের এটোম্যান সাম্রাজ্য বিস্তার বিষয়াবলির ওপর যদি কোনো সঠিক ইতিহাস পাওয়া
যায় তাও সংগ্রহ করা।
কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! তাবলিগ
সদস্যদের ভিসার আবেদন বাতিল হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দূতাবাস জানিয়ে দিয়েছে ভিসার আবেদন
আপাতত স্থগিত। কারণ ইউক্রেনে মালয়েশিয়ান বিমান দুর্ঘটনা ছাড়াও সিরিয়ার অনুরোধে
আইএস দমনে সে দেশে রাশিয়ার বিমান হামলাকে আমেরিকা সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াভাতে ছাই ঢেলে দেয়াটা সহ্য হচ্ছে না। ওদের ইচ্ছা ছিল আসাদ
সরকারকে সরিয়ে সে দেশে ইসরায়েলের মোসাদ কর্তৃক তৈরি নব্য জঙ্গি নামক আইএসকে সিরিয়ায়
প্রতিষ্ঠিত করা। আইএসের প্রধান খলিফা আবুবকর আল বাগদাদি একজন ইহুদি। ২০০৪ সাল থেকে
সিআইএর সাথে ঘনিষ্ঠতা শুরু তার। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাকে টানা দুই
বছর সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ইরাক হামলার সময় ছদ্মবেশে মসজিদের খতিব ছিলেন
বাগদাদি। সন্ত্রাসী এই খলিফা আসলে মুসলমান নন। তিনি একজন ইহুদি। এমন তথ্য বিশ্ববাসীর
কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে মুসলিম বিশ্ব বিশ্বাস করতে পারছে না। একই
কারণে ওয়াশিংটন আর মস্কোর মধ্যে একটা অঘোষিত দ্বন্দ্ব চলছে। এমন পরিস্থিতিতে ভিসা
না পাওয়ায় দলের সদস্যরা হতাশ হয়ে যে যেভাবে পারছে নিজ দেশে চলে যাচ্ছে। মিরাজ
সিদ্ধান্ত নিল দেশেই ফিরে যাবে। ইতিমধ্যে ফ্লাইট সিডিউল আর টিকিটও কনফার্ম করে
নিয়েছে। বেলা ঠিক ৪টার সময় তাবলিগে সফরকারী হোস্ট-গেস্ট উভয় আমির পক্ষের কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে হিরোশিমার ঝকঝকে ফুটপাতে নেমে এলো সে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে
ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। হিরোশিমা জাপানিদের শোকের স্মৃতি এলাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট বেলা আড়াইটায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি
দেখিয়ে ‘লিটল বয়’ নামের প্রথম আণবিক বোমাটি এখানেই ফেলেছিল। যার ওজন ছিল ৬০ কেজি।
এ বোমার বিস্ফোরণ ছিল ১৩ কিলোটন এবং তাপমাত্রা ছিল ৩৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ
বিস্ফোরণের পর প্রায় এক মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাজুড়ে ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছিল এবং হিরোশিমার
প্রায় ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছিল। এর তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে
২১ কিলোটনের ‘ফ্যাটম্যান’ নামের দ্বিতীয় বোমাটি ফেলা হয়। এসব বোমার তেজস্ক্রিয়ায়
লাখ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। বোমার তেজস্ক্রিয়ায় স্থানীয় কিন্ডারগার্টেনের ৫/৬ বছরের
শিশুদের মরণ চিৎকারে হিরোশিমার আকাশ হয়েছিল ভারি। স্বর্গের মতো সুন্দর হিরোশিমা
নাগাসাকি সেদিন নরকে পরিণত হয়েছিল। এই অচিন্তনীয় ধ্বংসলীলা দেখে বিস্ময়ে বোবা হয়ে
গিয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে কত ভয়ঙ্কর, কতটা মানবঘাতী হতে পারে
তা প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জাতিসংঘের লেভাসে আজও সারা
দুনিয়াজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মার্কিনিরা হলো বিশ্ব মোড়ল। বিশ্ব আজ এক জতুগৃহে পরিণত
হচ্ছে। সুপার পাওয়ার শক্তিশালী দেশগুলোর হাতে যে পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র আছে, তা
দিয়ে বর্তমান পৃথিবীকে তিনবার ধ্বংস করা যাবে। বর্তমান পরমাণু অস্ত্রের তুলনায় হিরোশিমা
আর নাগাসাকিতে ফেলা আণবিক বোম নেহাতই শিশু ছিল। তাই এ কথা বলা যায় যে জি-৮-এর যে
কোনো দেশের মাথায় যদি একটু পাগলামিপনা পেয়ে বসে, তো গোটা বিশ্বে যে কোনো মুহূর্তে
নেমে আসতে পারে ভয়াবহ মৃত্যুর করুণ পরিণতি।
মিরাজ হাঁটতে হাঁটতে দেখলো হাতের
বাম পাশে একটি আমেরিকান আর্মি ব্যারাক! কিছুটা আশ্চর্য হলো সে। আরো কিছু দূর
যাওয়ার পর একজন স্থানীয় লোকের কাছ থেকে জানতে পারলো এরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
মিত্রবাহিনী সেজে এখনো এ দেশে অবস্থান করছে। তবে এখানের চেয়ে টোকিও আর ওসাকাতেই
নাকি ইউএস আর্মির সংখ্যা বেশি। মিরাজের হঠাৎ করে নিজ দেশের কথা মনে পড়তেই (প্রয়াত)
বাবার কথা মনে পড়লো। বছরটি ছিল ২০০২। বাবার বন্ধুদের সাথে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে
ঘরোয়া বিতর্কে মেতে উঠছিলেন। মা মেহমানদের জন্য চা নাশতার ব্যবস্থা করে বসার ঘরে
পরিবেশনের জন্য মিরাজকে পাঠালে বাবার একটি কথা কানে যায়। বাবা বলেছিলেন বিশ্ব
ইতিহাসে বাংলাদেশের একটি ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ
থেকে এত দ্রুত মিত্রবাহিনী প্রত্যাহারের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। স্বাধীনতার পর অন্ততপক্ষে
৫ বছর যদি এ দেশে মিত্রবাহিনী থেকে যেত তাহলে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হয়তো মরতে হতো
না এবং এ দেশের সেনা ছাউনিতেও এমন হত্যাযজ্ঞ হতো না। ’৭৫-পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে
অনুপ্রবেশকারী সরকারপ্রধানরা মিত্রবাহিনী প্রত্যাহারে সফল হতেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ
ছিল।
সত্যিই তো! ইতিহাসবিদরা তাই তো
বলেন ‘ইতিহাস হলো নগ্ন’। সঠিক সময়ে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্যকে উলঙ্গ করে দেয়।
মিরাজ ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাবার সেই দিনের কথাটির মর্মবাণী বুঝতে পারলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় ৭০ বছর আগে। কিন্তু জাপান সরকার এখনো তথাকথিত
মিত্রবাহিনী প্রত্যাহারে ব্যর্থ।
সামনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে
ট্যাক্সিতে নয় বাসে চড়লো সে। যানবাহনে চড়ার দোয়া পড়ে নিল ‘বিসমিল্লাহি মাজরেহা
ওয়ামুর ছাহা ইন্না রাব্বি লা গাফুরুর রাহিম’।