১
ডঁরেমি। ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলের একটি গ্রাম। গ্রামের
পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মিউজ নদী। এই গ্রামেরই সাধারণ গরিব কৃষক পরিবারে জোয়ান অব আর্কের
জন্ম। সে ছিল বেশ শক্ত-পোক্ত মেয়ে। মেয়ে বলে খায়-খাটুনিতে ভয় পেত না, বরং ভারী কাজ
করতে খুশি হয়ে এগিয়ে আসত। ক্ষেতের কাজে, সবজি বাগানের কাজে বাবাকে সে সাহায্য করত।
গোয়াল ঘরের সব কাজ সে একাই করত। ঘরে মায়ের ঘরকন্নার টুকিটাকি কাজে এগিয়ে আসত। তবে তার
নিজের গর্ব ছিল, সুন্দর করে সুতো কাটা আর সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজের জন্য।
তার বাবা জাক দার্ক ছিলেন গ্রামের মাতবর ধরনের লোক। গির্জার পাশেই ছিল
তাদের পাথরের তৈরি ঘর। সাধারণ গরিব চাষি, বড় কিছু
করার কথা স্বপ্নেও ভাবতেন না। ঘরের মেঝে সবসময় স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকত। গোসলখানা
ছিল না। ওই গ্রামের লোকজনের বাড়ি খুব যে ঝকঝকে তকতকে হয় এমন নয়।
বাবা-মা দু’জনেই
ছিলেন, যাকে বলে, কট্টর ধার্মিক। পাঁচ-পাঁচটি সন্তানকে ভালো ক্যাথলিক বানিয়ে ছাড়বেন
এটাই ছিল তাঁদের প্রতিজ্ঞা। বাবা-মার মতো জোয়ানও লেখাপড়া শেখেনি। মা ইসাবেলার কাছে
জোয়ান প্রার্থনা করতে শিখেছিল, আর গির্জায় গিয়ে কী করতে হবে, গির্জার আদব-কায়দা, এই
সব। জোয়ান খুব মন দিয়ে ধর্ম-কর্ম করত, হয়তো
ওর খেলার সঙ্গী-সাথীদের কাছে এসব বাড়াবাড়ি বলে মনে হতো। তারা জোয়ানকে এ নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা
করতে ছাড়ত না।
ডঁরেমির লোকজন চার্লসকে খুব মান্য করত, তাঁর প্রতি খুব অনুগত ছিল। ডঁরেমির
তিন দিকেই ছিল বার্গেন্ডির সীমানা, আর একদিক, পশ্চিমে ছিল লরনের জমিদারি। ফ্রান্সের
মূল ভূখণ্ড থেকে বহু দূরে ডঁরেমি ছিল বিচ্ছিন্ন
দ্বীপের মতো। বার্গেন্ডির বা ইংল্যান্ডের সেপাইরা এসে মাঝে-মধ্যে গ্রামে হানা দিত,
ঘরবাড়ি পোড়াত, গরু-বাছুর, ছাগল-মোষ এমনকি হাঁস-মুরগি জোর করে তুলে নিত। দাম তো দিতই
না, উল্টো মারধরও করত। যুদ্ধের বাস্তবতা সম্পর্কে জোয়ানের ধারণা ছিল স্পষ্ট। শুধু তারই
নয়, ডঁরেমির সব অধিবাসীরাই জানত, এমনকি ছোট্ট জোয়ানও জানত তাদের আসল শত্রু কে?
জোয়ান তখন তেরো বছরে পা দিয়েছে। সে সবজি বাগানের কাজ করছিল। দুপুরবেলা।
গির্জায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। এমন সময় সে একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। চমকে উঠে চারদিকে
তাকিয়ে সে কোনো মানুষজন দেখতে পেল না, দেখল রাশি রাশি উজ্জ্বল আলোকরশ্মি। মানুষের মুখের
এই আওয়াজের কথা সে কাউকে বলেনি। এ রকম ঘটনা আবারও ঘটল। এবার সে আলোর মধ্যে দেখতে পেল
এক সম্ভ্রান্ত দেবদূত সেন্ট মাইকেলকে। এভাবে পর পর এলেন আরও দেবদূত। সাধ্বী মার্গারেট,
সাধ্বী ক্যাথরিন।
তাদের গির্জায় সাধ্বী মার্গারেটের একটি সুন্দর মূর্তি ছিল। আর নদী পেরোলেই
যে গ্রাম, ম্যাক্সি, সেই গ্রামের দেবী হলেন সাধ্বী ক্যাথরিন। এঁরা সবাই জোয়ানকে ভালো
মেয়ে হবার জন্য বললেন, উপদেশ দিলেন নিয়মিত গির্জায় যাওয়ার জন্য।
জোয়ান এঁদের এত ভালোবাসত, এত শ্রদ্ধা-ভক্তি করত যে, এঁরা চলে গেলে ঝরঝর
করে কাঁদত, চোখের পানিতে বুক ভাসাত।
আমরা এ কালে সব ব্যাপারেই প্রশ্ন করি, একটু খটকা লাগলেই জিজ্ঞেস করি।
জোয়ান এঁদেরকে দেখলে যেমন খুশি হতো, অবাকও হতো। সে কিন্তু কোনো দিন মুখ ফুটে কিছুই
জিজ্ঞেস করত না। এটা মনে রাখা দরকার, সে সময়টা ছিল মধ্যযুগ। গ্রামের এক অশিক্ষিত মেয়ের
কথা বাদই দিই, সেই যুগে যাঁরা লেখাপড়া জানতেন, তাঁরাও অনেক কিছুই বিশ্বাস করতেন। যেমন,
দৈত্যদানব, পরি, শাপ, বর, ডাইনি, জাদুবিদ্যা - এইসব। তার ওপর ধর্মের প্রভাব ছিল বেশি। বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিল না, ফলে ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারের ছাপ পড়ত সবখানেই। যুক্তি
দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে যা বোঝা যায় না, তারা তাও সহজেই মেনে নিত।