১৯৮৭ সালে ‘দাঁড়কাক’ নামে আমি একটি গল্প লিখি। গল্পের
পটভূমি একজন মানুষের নিজের এক টুকরো জমি পাওয়ার স্বপ্ন।
এমন তিন-চারজন মানুষকে আমি দেখেছিলাম ১৯৮১ সালের
ডিসেম্বর মাসে বরগুনা জেলার বামনা উপজেলার ডৌয়াতলা গ্রামে। গ্রামটি আমার
শ্বশুরবাড়ি। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত বরগুনা জেলা বঙ্গোপসাগর থেকে খুব দূরে
নয়। সাগরের কাছাকাছি হলেও বাংলাদেশের অন্য আর সব গ্রামের মতো। যেমন এর প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য, তেমন এর দরিদ্র জনজীবন। আমি ঢাকায় থাকি। চাকরি করি। কিন্তু গ্রামে যেতে
খুব ভালোবাসি। শুধু কর্তব্যের কারণে নয়, সাগরপারের এই গ্রামটিতে আমি যাই নেশার
টানে। মানুষ এবং প্রকৃতিকে একসঙ্গে দুচোখ ভরে দেখব বলে। হেঁটে যাচ্ছিলাম ধুলো-ওড়া
এবড়ো-থেবড়ো মেঠোপথে। দুপাশে ধানখেত। পাকা ধানে নুয়ে আছে গাছগুলো। আমাকে দেখে দুজন
দৌড়ে এলো। বলল, এইফির মোগ জমি অইবে ভাবী।
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, জমি?
ওরা সবাই দিনমজুর। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, এমন দিনযাপন
ওদের। গ্রামে যখনই আসি তখনই ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। অবাক হয়ে ভাবি, আজ ওরা এমন
খুশি ঝলমলে চেহারা নিয়ে জমির স্বপ্ন দেখছে কীভাবে?
হেসে বললাম, কী ব্যাপার? কোথায় জমি?
ওরা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, হিলট্রাকে।
হিলট্র্যাক্টসে! ততক্ষণে আমি ধাতস্থ হই। বুঝতে পারি
ব্যাপারটা। ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলি, তোমরা যাচ্ছো হিলট্র্যাক্টসে?
ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রাম
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। দীর্ঘকাল ধরে পাহাড়ি আদিবাসী এই এলাকায়
বসবাস করছে। সত্যি কথা বলতে কী এটা পাহাড়িদের এলাকা। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র
নৃগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বাস করে। এদের নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং
জীবনযাপন পদ্ধতি রয়েছে। এই মানুষগুলোর জীবনে এমন একটি সময় এসেছিল যখন তারা মনে করেছিল
যে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল।
দিন গড়াল। সরকার তার সামরিক শক্তি দিয়ে মুখোমুখি হলো এই জনগোষ্ঠীর। অন্যদিকে,
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরিব মানুষকে জমি ও টাকার লোভ দেখিয়ে ওদের পার্বত্য
চট্টগ্রামে পাঠাতে শুরু করল। সরকারের এমন প্রত্যাশা ছিল যে অদূর ভবিষ্যতে এভাবেই
সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়িদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে ফেলা যাবে এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অশান্তি ও
বিদ্রোহের অবসান ঘটবে।
আমার এইসব ভাবনার মাঝে ভেসে আসে ওদের কণ্ঠ, মোরা,
সামনের মাসে যামু। সরকার কইছে জমি, বাড়ি, হালের গরু, নগদ টাকা সব দেবে।
হ্যাঁ, হিলট্র্যাক্টসে বাঙালিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন
প্রোগ্রামের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু তোমাদের মতো কাউকে ওখানে যেতে দেখিনি। যাচ্ছো,
যাও।
ওরা এত খুশি যে নিজেদের আনন্দ ধরে রাখতে পারছিল না।
কোথায় যাচ্ছে, কী হবে ওখানে গিয়ে এমন কোনো অনিশ্চয়তার ছাপ ওদের চেহারায় ছিল না।
বরং একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা ওদের মাঝে প্রবল হয়ে উঠেছিল। একজন বলল, মোগ
দোয়া কইর্যেন ভাবী।
নিশ্চয়ই দোয়া করব। ভালো থেকো।
কথাগুলো বলার সময় বুকের ভেতর কেমন জানি একটু টান পড়ল।
কেননা ততদিনে অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের খবর আমরা পেতে শুরু করেছিলাম। বাঙালি
বসতির সঙ্গে শান্তিবাহিনীর সংঘাত শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে দুপক্ষেরই হতাহত
হওয়া, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, নির্যাতন ইত্যাদির সংবাদ পত্রিকার মাধ্যমে
পাচ্ছিলাম।
আমার সামনে থেকে ওরা ততক্ষণে আবার ধানখেতে ফিরে গেছে।
খানিকক্ষণ মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকি। ধানকাটা দেখি। হু-হু করে উত্তুরে বাতাস এসে
ছুঁয়ে যায়। শীতের দুপুর। ওদের হাতের কাঁচিতে নুয়ে পড়া পাকা ধান। এমন অপরূপ দৃশ্য
থেকে চোখ সরে না। সেই সঙ্গে নেপথ্য সংগীতের মতো ধ্বনিত হয় চড়ুই এবং শালিকের
কিচিরমিচির। কেবলই মনে হয় আর কয়েক দিন পরে এই গ্রাম থেকে হারিয়ে যাবে কয়েকজন
মানুষ। আবার যখন আসব ওদের সঙ্গে দেখা হবে না। আমার সঙ্গে ছিল মুনা আর লারা। ওরা
গাঁয়ের অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করছিল। আমাকে ফিরতে দেখে দৌড়ে এসে আমার
দুহাত ধরে। লারা দু-তিনজন খেলার সাথীকে দেখিয়ে বলে, মা ওরা নাকি আর এ গ্রামে থাকবে
না। ওরা কোথায় যাবে?
“ ” - Jayes Khisa