logo
0
item(s)

বিষয় লিস্ট

রকিব হাসান এর চরমপত্র

চরমপত্র
এক নজরে

মোট পাতা: 132

বিষয়: রোমহর্ষক

ম্যানহাটান হোটেলের বলরুম। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে লোকজন। অথচ কয়েক মিনিট আগেও হই-হুল্লোড় করছিল ওরা। আনন্দে। পুলিশপ্রধান ড্রেক ডানকান মেয়র হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তারই পার্টি চলছিল।

হ্যাঁচকা টানে মুসাকে সরিয়ে আনল কিশোর। আরেকটু হলেই মুসার গায়ের ওপর এসে পড়েছিল টাক্সেডো পরা লোকটা। দরজার দিকে ছুটে গেল সে।

ছোটাছুটি শুরু করেছে আরও অনেকেই। তাদের আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন ড্রেক, মুখের সামনে মাইক্রোফোন। ‘দোহাই আপনাদের, হুড়াহুড়ি করবেন না। লাইন দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যান।’

কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। ধোঁয়া ঘন হচ্ছে। লোকের চিৎকারে ঢাকা পড়ে গেল তার কণ্ঠ।

‘দরজা বন্ধ!’ চেঁচিয়ে উঠল একজন। ‘আমরা আটকা পড়েছি!’ কাশতে শুরু করল সে। কেশে উঠল আরও কয়েকজন। কার আগে কে বেরোবে সেই চেষ্টা করছে এখন সম্মানিত অতিথিরা।

এত ঘন হয়ে গেল ধোঁয়া, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকেও পরস্পরকে দেখতে অসুবিধে হচ্ছে কিশোর আর মুসার। টেবিল থেকে একটা ন্যাপকিন তুলে নিয়ে মুখে চেপে ধরল কিশোর।

‘কী করব এখন?’ মুসার প্রশ্ন। জানে, হুড়াহুড়ি করে লাভ হবে না।

‘চুপ থাক,’ চেঁচিয়ে জবাব দিল কিশোর। কিন্তু এত গোলমালের মাঝে কী করে চুপ থাকবে নিজেও বুঝতে পারল না।

আরও কিছুক্ষণ এই গণ্ডগোল চলল।

তারপর হঠাৎ অনুভব করল ধোঁয়া আর তত ঘন নয়। বলল, ‘আরে, পাতলা হয়ে এসেছে! এয়ারকন্ডিশনার চালু হয়ে গেছে আবার।’

‘হ্যাঁ,’ মুসা বলল। ‘আগুনটা নিভিয়ে ফেলেছে আরকি।’

ঘরের অন্য লোকজনও সেটা বুঝতে পারল। কমে এলো চেঁচামেচি, গুঞ্জনে রূপ নিল সেটা। ভেড়া বনে গেছে যেন মানুষগুলো।

মাইক্রোফোনে স্পষ্ট হলো আবার ড্রেক ডানকানের কণ্ঠ, ‘গোলমালটা বোধহয় মিটল। কী হয়েছিল, খোঁজ নিচ্ছি। আপনারা শান্ত থাকুন।’

রাগে হাত ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল একজন, ‘কিন্তু এখনও তো আটকেই রয়েছি আমরা! হচ্ছেটা কী?’

যেন তার প্রশ্নের জবাবেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল বলরুমের দরজা। তালা ভেঙে খোলা হয়েছে বোধহয়। ঘরে ঢুকল কয়েকজন পুলিশ।

‘নিশ্চয় ড্রেক খবর পাঠিয়েছিলেন,’ কিশোর বলল। ‘রেডিওতে যোগাযোগ রেখেছিলেন ওদের সঙ্গে।’

একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে মিনিটখানেক কথা বললেন ড্রেক, তারপর মাইক্রোফোনে বললেন, ‘ধোঁয়ার কারণ এখনও জানি না আমরা। আগুন দেখা যায়নি। শান্ত থাকুন আপনারা।’ ওপরের দিকে হাত তুলে জোরে জোরে নাড়লেন তিনি। ‘ভয়ের কিছু নেই। আসুন, আমাদের পার্টি চালিয়ে যাই।’

তার কথা সমর্থন করল অনেকেই। আবার বেজে উঠল ব্যান্ড : স্মোক্‌স্ গেটস ইন ইওর আইজ।

‘চোখে ধোঁয়া লাগছে তোমার,’ হেসে বলল কিশোর, ‘বাহ্, চমৎকার।’

‘ফালতু,’ মুসা বলল। ‘ধোঁয়া বেরিয়েছে বলেই ধোঁয়ার গান। বেটারা পাগল। এটা একটা সুর হলো নাকি।’ অতিথিদের ওপর চোখ বোলাল সে। ‘বুড়ো হয়েছে তো। এ রকম ঢিলা সুর ছাড়া আর কী পছন্দ করবে!’

‘বুড়ো এবং ধনী। চাচা বলল না, ইচ্ছে করেই এদের দাওয়াত করেছেন ড্রেক, যাতে প্রচুর চাঁদা ওঠে, ভালোমতো ক্যানভাস করতে পারেন তিনি। অনেক টাকা দরকার।’ সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা লোকগুলোর ওপর ঘুরছে কিশোরের চোখ।

নিখুঁত ছাঁটের সুট পরে, গলায় টাই বেঁধে অস্বস্তি বোধ করছে দুই গোয়েন্দা। এই গরমকালে এসব পরতে ভালো লাগে? তার চেয়ে সাধারণ প্যান্ট আর গেঞ্জি হলে অনেক আরাম হতো।

‘কিন্তু ওসব পরে যাওয়া চলবে না,’ বলে দিয়েছেন কিশোরের চাচা রাশেদ পাশা। ‘তবে পার্টিতে যেতে না চাইলে, ড্রেক ডানকানের সঙ্গে দেখা করতে না চাইলে আলাদা কথা। মোটকথা, যেতে হলে সুট আর টাই পরেই যেতে হবে। নইলে ঢুকতেই দেবে না তোমাকে ওরা।’

ড্রেককে দেখার, তার সঙ্গে কথা বলার প্রচণ্ড আগ্রহ দুই গোয়েন্দার, কাজেই বাধ্য হয়ে টাইয়ের ফাঁস গলায় এঁটেছে। গিঁট টানছে, আর খানিক পর পরই বিড়বিড় করে ‘হতচ্ছাড়া টাইয়ের’ চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করছে মুসা।

পুলিশ-চিফ ড্রেক ডানকানের কথা রাশেদ পাশার মুখে অনেক শুনেছে ওরা। সেজন্যই এই কৌতূহল। নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশে একসময় তারা দুজনেই ডিটেকটিভ ছিলেন। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করেছেন, রোমাঞ্চকর অপারেশনে গিয়েছেন একসঙ্গে। ডিপার্টমেন্টে ইতিহাস হয়ে আছে দুজনের সেসব অপারেশনের কাহিনী।

রহস্য সমাধানের প্রচণ্ড নেশা রাশেদ পাশার। বর্তমানে স্যালভিজ ইয়ার্ডের ব্যবসা ভালো না হওয়ায় রকি বিচ ছেড়ে নিউ ইয়র্কে এসে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস খুলেছেন। আদি বাসস্থান বাংলাদেশে হলেও বর্তমানে তিনি আমেরিকার নাগরিক। বিয়ে করেছেন এক আমেরিকান মহিলাকে। নিউ ইয়র্ক শহর থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে আটলান্টিকের তীরে একটা ছোট্ট সুন্দর শহর ইয়েলো বিচে থাকেন। মুসা আর রবিনের পরিবার এখনও রকি বিচেই থাকে। স্কুলের ছুটিতে মুসা বেড়াতে চলে এসেছে নিউ ইয়র্কে, কিশোরদের বাড়িতে। রবিনের জরুরি কাজ থাকায় আসতে পারেনি।

যাই হোক ড্রেক ডানকানের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব রাশেদ পাশার। গার্ডিয়ান-ব্ল্যাক পুলিশ অফিসারস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা হয়েছেন। মেয়র হওয়ার ইচ্ছেটা প্রথম রাশেদ পাশার কাছেই প্রকাশ করেছেন ড্রেক।

‘ওর পার্টিতে তাই আমাকেই আগে দাওয়াত করেছে ড্রেক,’ রাশেদ পাশা বলেছেন ছেলেদের। ‘তোমাদেরও নিয়ে যেতে বলেছে। তোমরা যে গোয়েন্দা হতে চাও, কয়েকটা কেসের কিনারা ইতোমধ্যেই করে ফেলেছ, তাকে বলেছিলাম। বোধহয় বাড়িয়েই বলে ফেলেছি। তোমাদের দেখতে চেয়েছে ড্রেক।’

‘আমারও খুব ইচ্ছে তাকে দেখার,’ কিশোর বলেছে। ‘তোমার মুখে তার গুণের কথা যা শুনেছি, বুঝতে পারছি, মেয়র হয়েও নাম কামাবেন।’

‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়,’ মুসা বলেছে।

‘বেশ,’ বলেছেন রাশেদ পাশা, ‘তাহলে আমার সঙ্গেই যাবে। আগেই হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, তোমাদের বয়সী কাউকে পাবে না পার্টিতে, সব বুড়ো। আর পলিটিক্যাল পার্টিগুলো কেমন হয়, ভালোই জান। পরে বলতে পারবে না যেন বোর হয়ে গেছ।’

‘বোর তো হবই,’ হেসে বলেছে মুসা, ‘সহ্য করব আরকি।’ রসিকতা করেছে, ‘যদি বল, সাদা রং মেখে পাকা করে নিই চুল। হাহ্ হাহ্।’

‘আর কোমরে কাপড়ের পোঁটলা,’ কিশোরও হেসেছে, ‘ভুঁড়ি হয়ে যাবে।’ চাচার পেটের দিকে তাকিয়েছে সে। এ বয়সেও সুন্দর স্বাস্থ্য রাশেদ পাশার, তবু, পেটে মেদ আরেকটু কম থাকলে ভালো হতো, তিনি নিজেই অনুভব করেন।

পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছেন তিনি, ‘খাওয়ার ব্যাপারে আরেকটু সতর্ক হতে হবে, বুঝি। চকলেট ছেড়ে দিলেই হতো। দেখি।...’

বলরুমে দাঁড়িয়ে এখন সেসব কথাই মনে পড়ছে কিশোরের। বলল, ‘চাচাকে জিজ্ঞেস করি, ধোঁয়ার কারণ কিছু বুঝতে পেরেছে কি না।’

‘কিন্তু কোথায় গেলেন আঙ্কেল?’ সারা ঘরে চোখ বোলাল মুসা। ‘শেষবার দেখেছিলাম নিরম্যান জাম্বিয়ার সঙ্গে কথা বলছে।’

‘তাহলে জাম্বিয়াকেই জিজ্ঞেস করি, চলো। এই সুযোগে তার সঙ্গেও পরিচয়টা হয়ে যাবে।’

লম্বা সম্ভ্রান্ত চেহারার লোকটাকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে চাচার কথা জিজ্ঞেস করল কিশোর। মাথা ঝাঁকালেন তিনি, ‘কি জানি, এখন কোথায় বলতে পারব না। কথা তো বলেছিলাম। কদিন ধরেই কোন বদমাশ জানি উড়ো চিঠি দিয়ে হুমকি দিচ্ছে আমাকে। কথা শেষ করতে পারিনি, ধোঁয়া আসতে শুরু করল। কারণ জানতে চলে গেল তোমার চাচা। তাকে তো ভালোমতোই চেনো, রহস্যের গন্ধ পেলেই হয়, ব্লাডহাউন্ডের মতো ছোটে...’

‘কোনদিকে গেছে?’

‘তা তো বলতে পারব না। হয়তো বাইরে গেছে পুলিশকে সহায়তা করতে।’

দরজার দিকে রওনা হলো মুসা। কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরে তাকিয়ে কিশোরকে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো, বাইরে গিয়ে দেখি।’

বলরুমের বাইরেও রাশেদ পাশাকে পাওয়া গেল না। লবিতে গিজগিজ করছে পুলিশ আর দমকল বাহিনীর লোক। কিন্তু কেউই তারা তাকে দেখেনি। অনেকে চেনেই না, দেখতে কেমন তা-ই বলতে পারবে না।

‘ড্রেক হয়তো কিছু বলতে পারবেন,’ মুসাকে বলল কিশোর। ‘গোলমাল শুরু হলে নিশ্চয় তার কাছেই গিয়েছিলেন চাচা।’

বলরুমে ফিরে এলো আবার ওরা।

ড্রেককে জিজ্ঞেস করতে হলো না, দুই গোয়েন্দাকে দেখে তিনিই হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন। কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই, তোমার চাচা কোথায়? ওর সঙ্গে পরিচিত হতে চাইছে কয়েকজন।’

‘আমরা তো আপনাকেই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম,’ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল কিশোর।

‘গেল কোথায়?’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল মুসা। ‘কিশোর...’ কথা শেষ করতে পারল না সে, বাধা পড়ল, তীক্ষ্ণ গুঞ্জন তুলেছে ড্রেকের বুক পকেটে রাখা একটা যন্ত্র।

‘কে আবার কথা বলতে চায় এ-সময়...’ বলতে বলতে পকেট থেকে ছোট বিপারটা বের করলেন তিনি। সুইচ টিপতেই কথা বলে উঠল খুদে স্পিকার, ‘হাই, চিফি,’ হাসিহাসি কণ্ঠ, কিচমিচ করে উঠল যেন একটা চড়ুই পাখি, গলার স্বর যাতে চেনা না যায় সেজন্য বিকৃত করে ফেলেছে, ‘তোমার দোস্ত রাশেদ পাশাকে খুঁজছ তো? খুঁজো না খুঁজো না, লাভ হবে না। পাবে না খুঁজে। আমি যা বলব না শুনলে পাবে অবশ্য, তবে ওরকমভাবে পাওয়া পছন্দ হবে না তোমার।’ এক মুহূর্ত থামল লোকটা, তারপর কণ্ঠস্বর আরেক রকম করে ফেলে বলল, ‘রাশেদ পাশাকে পাবে, বুঝলে বুড়ো খোকা? আস্তই পাবে, তবে মরা। একেবারে বরফের মতো শীতল লাশ। আমি আবার বলছি, লাশ।’

 

সংশ্লিষ্ট বই

পাঠকের মতামত
  • Rating Star

    “ ” - Rakibul Dolon

রিভিউ লিখুন
রিভিউ অথবা রেটিং করার জন্য লগইন করুন!