logo
0
item(s)

বিষয় লিস্ট

শান্তা মারিয়া এর জ্ঞানতাপস ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

জ্ঞানতাপস ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
এক নজরে

মোট পাতা: 129

বিষয়: আত্মজীবনী

শৈশব ও শিক্ষাজীবন

 

ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা ছোট্ট একটি গ্রাম। কলকাতা শহর থেকে খুব দূরে নয়। সন্ধ্যে হলে গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে প্রদীপের আলো। ভোরবেলা শোনা যায় আজানের ধ্বনি। এই গ্রামের নাম পেয়ারা। চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার একটি গ্রাম পেয়ারা। এই গ্রামের একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ মুন্সী মফিজুদ্দিন। বেশ শিক্ষিত লোক তিনি। কলকাতায় কোর্টে চাকরি করতেন। ইংরেজি তো বটেই, আরও চার পাঁচটা ভাষা জানতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল হুরুন্নেসা। তিনিও লেখাপড়া জানতেন। ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই। দিনটি ছিল শুক্রবার। তখন ঘোর বর্ষা। মুন্সী মফিজুদ্দিনের বাড়িতে শোনা গেল শিশুর কান্নার আওয়াজ। ছোট্ট একটি শিশু জন্ম নিয়েছে হুরুন্নেসার কোলে। ছেলেটির নাম রাখা হলো মুহম্মদ ইবরাহীম। আকিকাও হলো এই নামেই। কিন্তু নামটি পছন্দ হলো না মা হুরুন্নেসার। তিনি ছেলের নাম রাখলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মুন্সী মফিজুদ্দিনের আরও ছেলেমেয়ে ছিল। তাঁর ছিল তিন মেয়ে চার ছেলে। ভাইবোন সবার সঙ্গে মিলেমিশে বড় হতে লাগলো শহীদুল্লাহ। খুব হাসিখুশি শিশু। গান গায়, গানের তালে নাচে। ছেলেটিকে তাই অনেকে ডাকে সদানন্দ বলে। গ্রামের সবুজ প্রকৃতি খুব ভালো লাগে সদানন্দের। ভালো লাগে রাখালের সঙ্গে মাঠে মাঠে ঘুরে রাখালিয়া বাঁশির সুর শুনতে। একদিন তো পুকুর ঘাটে গেল আর ফিরে আসার নাম নেই। বাড়ির লোক চিন্তায় অস্থির। সন্ধ্যের সময় চুপিচুপি বাড়ি ফেরে সদানন্দ। রাখালের সঙ্গে সারাটা দিন ঘুরেছে মাঠে মাঠে, শুনেছে বাঁশির মিঠে সুর। কিন্তু এভাবে ঘুরে বেড়ালে তো চলবে না। শহীদুল্লাহকে ভর্তি করে দেয়া হলো গ্রামের পাঠশালায়। এই পাঠশালায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, কথামালা আর বোধোদয় পড়তেন শহীদুল্লাহ। সেই সঙ্গে কুরআন শরীফ পড়তে শিখলেন তিনি। বাড়িতে শিখলেন নামাজ পড়তে। দশ বছর বয়সে বাবার কর্মস্থল কলকাতার হাওড়ায় চলে এলেন তিনি। ভর্তি হলেন একটা মাইনর স্কুলে। এই স্কুল থেকে ১৮৯৯ সালে মিডল ইংলিশ পাস করলেন। তারপর ১৯০০ সালের জানুয়ারিতে ভর্তি হলেন হাওড়া জেলা স্কুলের ফোর্থ ক্লাসে (বর্তমানের ৭ম শ্রেণী)। স্কুলে তখন ইংরেজি, বাংলা ছাড়াও আরেকটি ভাষা পড়তে হতো। হিন্দু ছেলেরা পড়তো সংস্কৃত, মুসলমান ছেলেরা পড়তো ফারসি। শহীদুল্লাহ কিন্তু ফারসি না নিয়ে, পড়লেন সংস্কৃত। শহীদুল্লাহর স্মৃতিশক্তি ছিল খুব প্রখর। যা পড়তেন তাই মনে রাখতে পারতেন। শুধু স্কুলের পাঠ্য বই নয়, বাইরের নানা রকম বইও পড়তেন। কৃষ্ণকুমার মিত্রের লেখা মহম্মদ চরিত, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের কুরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ আর তাপসমালা পড়তে খুব ভালো লাগে তাঁর। অন্য ছেলেরা যখন ঘুড়ি উড়ায়, লাটিম কিংবা মার্বেল দিয়ে খেলে, মাঠে ফুটবল খেলে শহীদুল্লাহ তখন ঘরে বসে বইয়ের পাতায় চোখ রাখতেন। স্কুল জীবনেই ভাষা শেখার নেশা পেয়ে বসে শহীদুল্লাহকে। স্কুলে ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত তো পড়তে হতোই-এছাড়া ঘরে বসে তিনি শিখলেন ফারসি, হিন্দি, উর্দু আর উড়িয়া ভাষা। সেই সঙ্গে গ্রীক আর তামিল অক্ষরও লিখতে পড়তে শিখলেন। শুধু ভাষা শেখাই নয়, ভাষাগুলোর তুলনা করতেও ভালো লাগতো তাঁর। সংস্কৃত ভাষার একটি শব্দ বা ধাতুরূপ কেমন করে বদলে যায় তামিল, ল্যাটিন কিংবা বাংলা ভাষায় সেগুলো লিখে দেখতেন। স্কুলে পড়ার সময় হাফিজ ছিলেন শহীদুল্লাহর প্রিয় কবি। অবশ্য মূল ফারসিতে হাফিজের কবিতা তখনও পড়েন নি তিনি। ভাই গিরিশচন্দ্রের গদ্যানুবাদ পড়েছিলেন। সেখান থেকে একটা গজলের কাব্যানুবাদ করলেন। রামায়ণ থেকেও কিছু অংশ পদ্যে অনুবাদ করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে খুব আগ্রহী ছিলেন। আর নিজের ধর্মে তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। অবশ্য ধর্মানুরাগের বিষয়টি ছিল বংশগত। শহীদুল্লাহর পরিবার চতুর্দশ শতক থেকে বংশানুক্রমিকভাবে ২৪ পরগনার বিখ্যাত পীর সৈয়দ আব্বাসের (পীর গোরাচাঁদ) খাদেম ছিলেন। পীর গোরাচাঁদের মাজার ছিল পেয়ারার পাশে হাড়োয়া গ্রামে। পীর গোরাচাঁদের মাজারের প্রথম খাদেম ছিলেন শহীদুল্লাহর চৌদ্দতম পূর্ব পুরুষ শেখ দারা মালিক।

স্কুলজীবনে ইংরেজি আর বাংলায় শহীদুল্লাহ ছিলেন খুবই ভালো। ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর শিক্ষক নারিকেল গাছ নিয়ে একটি ইংরেজি রচনা লিখতে দিয়েছিলেন। শহীদুল্লাহর লেখা পড়ে শিক্ষক বিশ্বাসই করতে চান নি যে সেটা শহীদুল্লাহর নিজের লেখা। ক্লাসে বরাবরই তিনি ছিলেন ভালো ছাত্র। ৭ম শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষায় রুপার মেডেল পেয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে ভালো ছিলেন সংস্কৃতে। সংস্কৃতে সবসময়ই ফার্স্ট হতেন তিনি। একবার শহীদুল্লাহর হিন্দু বন্ধুরা কৌতুক করে পণ্ডিত মশাইকে বলেছিলো স্যার, আমরা বামুন কায়েতের ছেলে থাকতে, আপনি ঐ মুসলমান ছেলেটাকে সবসময় ফার্স্ট করে দেন, এতো ভারি অন্যায়। উত্তরে পণ্ডিত মশাই বলেন, আমি কী করবো, সিরাজুদ্দৌলা লেখে ভালো। তোরা তো ওর মতো লিখতে পারিস না। পণ্ডিত মশাই শহীদুল্লাহর নাম কিছুতেই মনে রাখতে পারতেন না, বলতেন সিরাজুদ্দৌলা।

১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করলেন শহীদুল্লাহ। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সী কলেজের এফ. এ (ফার্স্ট আর্টস) এর প্রথম বর্ষে। প্রেসিডেন্সী কলেজে শহীদুল্লাহর সংস্কৃত শিক্ষক ছিলেন মহামহোপাধ্যায় সতীশচন্দ্র আচার্য বিদ্যাভূষণ। ঐ সময় প্রেসিডেন্সী কলেজে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন বাংলার সেরা সব ব্যক্তি। কেমিস্ট্রি পড়াতেন স্যার পিসি (প্রফুল্ল চন্দ্র) রায়, ফিজিক্স পড়াতেন স্যার জি. সি. বসু, গণিতের অধ্যাপক ছিলেন ড. শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়। রায় বাহাদুর খগেন্দ্র মিত্র এবং ড. আদিত্য কুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন লজিকের অধ্যাপক। দু বছর পর এফ. এ পাস করে হুগলি কলেজে ভর্তি হলেন শহীদুল্লাহ। বি.এ তে তাঁর অনার্সের বিষয় ছিল সংস্কৃত। অসুস্থতার কারণে বিএ পরীক্ষা দেয়া হলো না তাঁর। এ বছরটা নষ্ট হবে এই ভেবে যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি শুরু করলেন। এক বছর পর কলকাতায় ফিরে এসে আবার ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করলেন। এ বছরই চব্বিশ পরগনা জেলার ভাসলিয়া গ্রামের মুহম্মদ মোস্তাকীমের মেয়ে মরগুবা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। মরগুবা খাতুন দেখতে যেমন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী, তেমনি গুণী মহিলা ছিলেন। আজীবন তিনি স্বামীকে বিদ্যাচর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। ১৯১১ সালে শহীদুল্লাহ সংস্কৃতে এম.এ পড়ার জন্য ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শহীদুল্লাহর সংস্কৃতে এম. এ পড়া নিয়ে দেখা দিল তুমুল বিপত্তি। এম.এ ক্লাসে সংস্কৃতের পাঠ্যসুচীতে বেদ পড়তে হতো। হিন্দু সনাতন ধর্মের গ্রন্থ হলো বেদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ ক্লাসে বেদ পড়াতেন একজন গোঁড়া পণ্ডিত অধ্যাপক। তিনি বললেন, শুধু ব্রাহ্মণরাই বেদ পড়তে পারে। শহীদুল্লাহর মতো একজন মুসলমানকে তিনি কিছুতেই বেদ পড়াবেন না। এই পণ্ডিত অধ্যাপকের নাম ছিল সত্যব্রত সামশ্রমী। শহীদুল্লাহর এই সংস্কৃত পড়ার ঘটনা নিয়ে সে সময় কলকাতা শহরে সব কাগজে অনেক লেখালেখি হলো। তিনি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়লেন। দি বেঙ্গলী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বলা হতো বাংলার মুকুটহীন রাজা। তিনি শহীদুল্লাহর পক্ষ অবলম্বন করলেন। তাঁর কাগজে তিনি কড়া ভাষায় সম্পাদকীয় লিখলেন এ নিয়ে। সে সময় ভারতের আরেকজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মওলানা মোহাম্মদ আলীও বিশেষভাবে লিখলেন যেন শহীদুল্লাহকে সংস্কৃত পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে বলা হতো বাংলার বাঘ। তিনিও পণ্ডিতমশায়কে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। গোঁড়া অধ্যাপক কারও কথাই শুনলেন না। শহীদুল্লাহর কলেজ জীবনের শিক্ষক সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ বললেন প্রাইভেটে এম.এ পরীক্ষা দিতে। আবার আরেকজন শিক্ষক বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বিষয় নিয়ে পড়তে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও বললেন অন্য বিষয়ে এম.এ পড়তে। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলা হলো। বিভাগটির নাম হলো তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব। এই বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন অধ্যাপক রবিদত্ত। শহীদুল্লাহ এই বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন। এবং এই বিভাগ থেকে প্রথম এম. এ ডিগ্রী লাভের গৌরব অর্জন করলেন। এইভাবে সংস্কৃতে এম.এ ডিগ্রী না পেলেও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব পড়ার সময়ই তিনি সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের সুযোগ পেলেন। বস্তুত, সংস্কৃত ছিল শহীদুল্লাহর অন্যতম প্রিয় ভাষা। সারাজীবনই তিনি এ ভাষার নানা বিষয় নিয়ে চর্চা করেছেন। ১৯১২ সালে এম. এ পাস করার পর তিনি বৃত্তি পেলেন জার্মানিতে গিয়ে সংস্কৃত পড়ার জন্য। বিদেশে যেতে হলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। শহীদুল্লাহর স্বাস্থ্য তেমন ভালো ছিল না। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল তাঁর অনুকূলে গেল না। ফলে সরকারি বৃত্তি পেয়েও জার্মানিতে তখন যাওয়া হলো না তাঁর। শহীদুল্লাহ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে লাগলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রজীবনে শহীদুল্লাহ সব সময়েই সাহিত্যচর্চা করেছেন। কলেজে পড়ার সময় ভারতী পত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার পাতায় প্রথম প্রকাশিত শহীদুল্লাহর এই রচনাটির নাম ছিল মদন ভস্ম। ভারতীর সম্পাদক তখন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন স্বর্ণকুমারী দেবী। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে একজন মুসলমান লেখকের আগ্রহ দেখে স্বর্ণকুমারী দেবী যেমন বিস্মিত তেমনি আনন্দিত হয়েছিলেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও লেখালেখি অব্যাহত রাখেন শহীদুল্লাহ। বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বাঙ্গালা ভাষা তত্ত্বে রবীন্দ্রনাথ, কোহিনূর পত্রিকায় বাঙ্গালীর সংস্কৃত উচ্চারণ, প্রতিভা পত্রিকায় ফারসি ও আরবি গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ ও তৎসম্পর্কে অক্ষারন্তরীকরণ প্রবন্ধ। প্রভাতী পত্রিকাতে তাঁর আরও কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ সময় কয়েকজন সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে মিলে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি। শহীদুল্লাহ ছিলেন এই সমিতির সম্পাদক।

সংশ্লিষ্ট বই

পাঠকের মতামত
রিভিউ লিখুন
রিভিউ অথবা রেটিং করার জন্য লগইন করুন!