logo
0
item(s)

বিষয় লিস্ট

রনজিৎ বিশ্বাস এর ভাষার যত গোলক ধাঁধা

বাড়তি বলার বাড়াবাড়ি

 

বাড়তি বলায়, বাড়তি লেখায় ও শব্দের সঙ্গে বাড়তি একটি বর্ণ জুড়ে দেওয়ায় আমাদের একটা ঝোঁক আছে। সবার নয়, কারও কারও। যেমন কোমরবন্ধ, গলবন্ধ, সেতুবন্ধ— এই শব্দ তিনটি একধরনের বাঁধার কাজ করে; কিন্তু ‘বন্ধন’-এর ‘ন’ সঙ্গে নেয় না। কোমরে বাঁধার বস্তু কোমরবন্ধ (বেল্ট), কোমরবন্ধন নয়; গলায় প্যাঁচানোর বস্তু গলবন্ধ (কমফার্ট, মাফলার ইত্যাদি), গলবন্ধন নয়। এবং দু’টি ধারণা কিংবা বিশ্বাসের মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক স্থাপন করার যে প্রক্রিয়া, তার নাম সেতুবন্ধ, সেতুবন্ধন নয়। তিনি দুই পক্ষের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ রচনার কাজ করলেন, এমন নয় যে তিনি দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে দিলেন। পাশাপাশি এটিও মনে থাকলে ভালো— মেলবন্ধন (মেলবন্ধ নয়), ভ্রাতৃবন্ধন (ভ্রাতৃবন্ধ নয়), রাখিবন্ধন (রাখিবন্ধ নয়)।

এমন বাড়তি ব্যবহারের সমস্যা আছে আ-কার (া) নিয়েও। [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মন্তব্যটি বেশ পুরানো। যে দর্শনার্থী তাঁকে বলেছিলেন, মহাশয়, আমার বড় ‘দুরাবস্থা’; তিনি তাকে বলেছিলেন, সে তো আ-কার দেখেই বুঝতে পাচ্ছি।] ‘দুরবস্থা’র জায়গায় ‘দুরাবস্থা’ লিখলে কোন অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, তা তো বুঝতে পারবই আমরা, বুঝতে পারব আরও কিছু শব্দের বেলায়ও। যেমন, ব্যবস্থা (ব্যাবস্থা নয়), ব্যয় (ব্যায় নয়), অব্যয় (অব্যায় নয়), মিতব্যয়ী (মিতব্যায়ী নয়), অত্যধিক (অত্যাধিক নয়), যদ্যপি (যদ্যাপি নয়) ও কৃতবিদ্য (কৃতবিদ্যা নয়)। নিষ্ঠ ও সত্যনিষ্ঠ (নিষ্ঠা যাঁর আছে, তিনি ‘নিষ্ঠ’; সত্যের প্রতি যাঁর নিষ্ঠা আছে, তিনি সত্যনিষ্ঠ; কর্তব্যের প্রতি যাঁর নিষ্ঠা আছে, তিনি কর্তব্যনিষ্ঠ) দেখেও আমাদের বিভ্রান্ত হলে চলবে না। ওখানে কিছু কম পড়েনি।

বাড়তি ব্যবহারের যন্ত্রণা য-ফলা (্য) নিয়েও। কার্য, কার্যালয়, তূর্য, উপলক্ষ ইত্যাদি নিজের নিজের চেহারাতেই ভালো আছে; তাদের কার্য্যালয়, কার্য্য, তূর্য্য ও উপলক্ষ্য বানানোর দরকার নেই।

‘তা’ দিয়েও আমরা কখনো কখনো যা-তা অবস্থা তৈরি করে ফেলি। দুর্বলতা ঠিক আছে, উৎকর্ষতা নয় (উৎকর্ষ); দারিদ্র্য ঠিক আছে, দারিদ্র্যতা নয়।

একটি ‘ক’ কে প্রয়োজনীয় ভেবেও আমরা সমস্যা বাড়াই। ভর্তিচ্ছু ঠিক আছে, ভর্তিচ্ছুক নয়, উপচিকীর্ষু (উপকার করায় আগ্রহী) ঠিক আছে, উপচিকীর্ষুক নয়। কোথাও কোথাও আবার বাড়তি ব্যবহার দরকারিও। সে বিষয়ে আজ নয়। ם


জব্দ করা শব্দ যত

 

প্রায় সব শব্দের একটি নয়, দু’টি অর্থ আছে। অথবা দুইয়ের বেশি অর্থও তার ওপর চাপানো যায়। একটি হচ্ছে তার শাব্দিক অর্থ। অর্থাৎ শব্দটি যে অর্থ সোজাসুজি প্রকাশ করে, সেই অর্থ। এটিকে আভিধানিক অর্থও বলা হয়। Dictionary Meaning.

আরেকটি অর্থ, তার অধিশাব্দিক অর্থ। অর্থাৎ সরাসরি ও সোজাসুজি যে অর্থ শব্দটি প্রকাশ করে, তার বাইরের অর্থ, তার চেয়ে বেশি অর্থ, অন্যরকম অর্থ ও ভিন্নরকম অর্থ।

প্রথম অর্থকে ইংরেজিতে বলা হয় denotation (ডিনোটেশন,) দ্বিতীয়টি connotation (কনোটেশন)। উদাহরণ দিয়ে বললে বোঝা যাবে, ব্যাপারটিতে কোনো ভজকট নেই, কোনো খটমটও নেই। যেমন, রুদ্র আমার বন্ধু। এখানে বোঝানো হচ্ছে রুদ্র নামের এক লোকের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্ক, যা থাকলে আমরা একে অন্যকে বন্ধু মানতে পারি। এটি হচ্ছে ‘বন্ধু’র শাব্দিক অর্থ। এটা ডিনোটেশন।

যদি বলা হয়, রুদ্রের মতো বন্ধু যার আছে, তার শত্রুর দরকার নেই। এখানে ‘বন্ধু’ অর্থ বন্ধু নয়। এখানে বন্ধু শব্দটি ব্যবহার করে চিনিয়ে দেওয়া হচ্ছে, শত্রুর চেয়েও ভয়াবহ এক মানুষকে। এটি শাব্দিক অর্থের বাইরের অর্থ, শাব্দিক অর্থের অতিরিক্ত কোনো অর্থ প্রকাশ করছে। এই অর্থের নাম ‘অধিশাব্দিক’ অর্থ। এটা কনোটেশন। উদাহরণ টানলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। শিক্ষক ছাত্র পিটিয়ে বলছেন কত গরু-গাধা পিটিয়ে মানুষ করলাম, তোকে পারলাম না। এখানে ‘মানুষ করা’ মানে ‘উপযুক্ত করে গড়ে তোলা’। এটি কনোটেশন।

এক বাড়িতে বাবা খেতে বসে দেখলেন, তরকারিতে লবণ ঠিকমতো পড়েনি। তার খোঁচানোর স্বভাব। তিনি তরকারি মুখে তুলে বললেন আমাদের পাড়ায় আজ বোধহয় লবণের আকাল। যাদের বোঝার, তারা ঠিকই বুঝে নিতে পারল, ভদ্রলোক আসলে কী বলতে চাচ্ছেন। এটি কনোটেশন।

সোজাসুজি যদি তিনি বলতেন, তরকারি আজ আলুনি হয়েছে, সেটি হতো ডিনোটেশন।

বাসের ড্রাইভারকে একদিন বলতে শোনা গেল, তার জবানেই বলি অই বেডা হেলপার, পা চালাস না ক্যান। পায়ে কি মেন্দি লাগাইছস? এটি কনোটেশন।

এভাবে প্রতিদিন আমরা শব্দকে বিভিন্নভাবে Connote করছি, অধিশাব্দিক অর্থে ব্যবহার করছি। বন্ধুর সঙ্গে, ভাইবোনের সঙ্গে, মা-বাবার সঙ্গে, শিক্ষকের সঙ্গে, সন্তানের সঙ্গে ও বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষের সঙ্গে এবং পরিচিত-অপরিচিত অনেকের সঙ্গে আমরা শব্দ নিয়ে খেলছি। শব্দ Connote করে বেড়াচ্ছি।

যে কোনো দিন denotation-connotation শোনেনি, সেও করছে। যেমন, এক শিশু তাকে যখন তার বাবা অফিসে যাওয়ার সময় বলেন, ‘আমার জুতোজোড়া মানুষ করে দে তো মা’, সে কাজটি ঠিকই করে দেয়। প্রশ্ন করে না, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ বাবা! জুতা আবার মানুষ হয় নাকি।

অধিশাব্দিক অর্থে শব্দ আমরা ব্যবহার করি। কারণ, তা ভাষাকে সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত করে। ভাষাকে আকর্ষণীয় করে। সব সময় এ জন্য আমাদের যে খুব পরিশ্রম করতে হয়, তা-ও নয়। কেমন করে তা যেন এসে যায়। প্রচণ্ড মনোযোগ ঢালা ছাড়াও অধিশাব্দিক অর্থে দাবি পূরণ হয়ে যায়।  ם

সংশ্লিষ্ট বই

পাঠকের মতামত
রিভিউ লিখুন
রিভিউ অথবা রেটিং করার জন্য লগইন করুন!