শঙ্খনীল মুগ্ধতা
১৯৮০ সাল। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।
পাঠ্যবইয়ের বাইরেও গল্প-উপন্যাসের প্রতি আমার বাড়তি ঝোঁক। বিশেষ করে রহস্য
উপন্যাস। কাজী আনোয়ার হোসেন, রোমেনা আফাজ, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, নিমাই ভট্টাচার্য্য
প্রায় শেষ। আমি যেখানে পড়াশোনা করি, এটা একটা আধা সামরিক আবাসিক বিদ্যালয়। পড়ি
ক্লাস নাইনে, কিন্তু কাগজে-কলমে ক্লাস সেভেন থেকেই ওটাকে কলেজ বলা হয়। ক্যাডেট
কলেজ।
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের লাইব্রেরিটা চমৎকার।
দোতলা দালানের এই লাইব্রেরি ভবনে থরে থরে বই। ইংরেজি এবং বিদেশি বই-ই বেশি। বাংলা
বইও একেবারে কম নয়। কিন্তু আমার পছন্দের বইগুলো দোতলার কোনার দিকের শেলফে। এখানে
বাংলা ফিকশনের সমাহার।
নাম না-জানা কিংবা অচেনা লেখকদের ভালো বই বেছে
নেওয়ার একটা কৌশল আবিষ্কার করি আমি। বইয়ের তাকে যে বইটির মলাট ছেঁড়া বা ঝুলঝুলা
বাঁধাই, এ রকম বই-ই বেশির ভাগ সময়ই লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করি। একসময় ফিকশনের শেলফে
বাঁধাই-ছুটে-যাওয়া একটা বই দেখি। নাম শঙ্খনীল
কারাগার। লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ।
কিছুদিন আগে এক বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ
টেলিভিশনে হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত একটা নাটক দেখেছিলাম। নাম নির্বাসন। মুক্তিযুদ্ধে
আহত পঙ্গু এক তরুণ বিছানায় শুয়ে থাকে। জরী নামের একটি মেয়েকে সে পছন্দ করত, তার
বিয়ে হয়ে যায়। ঘরে বসে ছেলেটা সারা দিন উল্টা সংখ্যা গোনে। গল্প হুমায়ূন আহমেদের।
নাট্যরূপ দিয়েছেন অভিনেতা আফজাল হোসেন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ নাটকটি প্রযোজনা
করেছিলেন।
শঙ্খনীল
কারাগার হাতে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই। ঔপন্যাসিক হিসেবে এ নামের কোনো লেখকের
কথা তো শুনিনি! হাতে নিয়ে বইটি ওল্টাই। দেখি, প্রায় পুরো বইটিই আন্ডারলাইন করা।
কয়েক হাতে করা। কিছু পেনসিলে, কিছু লাল কালির কলমে, কিছু বলপয়েন্টে। বইটি ইস্যু
করার জন্য লাইব্রেরিয়ানের কাছে যাই। সর্বোচ্চ সাত দিন নিজের কাছে রাখা যায় বই। সাত
দিনের পর ফেরত দিলে দিনপ্রতি ২৫ পয়সা জরিমানা। বই কেউ ফেরত না দিলে মহা শাস্তি।
কলেজ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত হতে পারে।
লাইব্রেরিয়ান শামসু ভাই হতাশ করে দিয়ে বলেন,
দুই দিনের মধ্যে এ বই ফেরত দিতে হবে। কিছু বই বাঁধাইয়ের জন্য চট্টগ্রাম পাঠানো
হবে। এ বইটাও যাবে। এ বইটির চাহিদা অনেক, দ্বিতীয় কোনো কপি নেই। আমি রেজিস্ট্রি
বুকে সাইন করে বইটি নিয়ে হাউসে চলে যাই।
ক্যাডেট কলেজে অনেক জটিল নিয়মকানুন। দুপুরের
খাবারের পর ‘রেস্ট টাইম’ ৪৫ মিনিট। এ সময় চিত হয়ে শুয়ে থাকা বাধ্যতামূলক। প্রথম ১৫
মিনিট পার হলে রুম প্রিফেক্টের অনুমতি নিয়ে বাকি আধা ঘণ্টা ‘গল্পের বই’ পড়া যায়। এ
সময় ক্লাসের বই পড়া নিষেধ। পরবর্তী ৩০ মিনিট ফ্রি টাইম। ফ্রি টাইমে যেকোনো বই পড়া
যায়; চিঠি লেখা, জুতা পালিশ করা যায়। এর পর বাকি দেড় ঘণ্টা ‘আফটারনুন প্রেপ টাইম’।
প্রেপ টাইমে গল্পের বই পড়া নিষেধ। ক্যাডেট কলেজের ছেলেরা চালাক-চতুর হয়। আইন ভাঙার
কৌশল বের করতে তাদের সমস্যা হয় না।
আমি রেস্ট টাইমেই বইটি পড়া শুরু করে দিই।
রেস্ট টাইম-ফ্রি টাইম শেষ, বই শেষ হয় না। এর মধ্যেই বাংলা বইয়ের মলাট এঁটে দিয়েছি শঙ্খনীল কারাগার-এর মলাটের ওপরে। ফ্রি
টাইম শেষে বই নিয়ে ‘প্রেপ’-এ যাই। নোট খাতা আর কলম নিয়ে বসে থাকি। আমার সামনে
পাঠ্যবইয়ের মলাটের ভেতর শঙ্খনীল কারাগার।
বই পড়ি, কয়েক লাইন পর পর খাতার ওপর লিখি—মন্টুর কথা, রাবেয়ার কথা, রুনু-ঝুনুর কথা,
সদ্য রিটায়ার করা বাবার কথা। রাবেয়া আপার জন্য আমার খুব মন খারাপ হয়। এই আপা অনেক
দুঃখী। তাঁর বিয়ে হচ্ছে না। গায়ের রংটা যে কালো তাঁর!
দুপুরের প্রেপেও বইটা শেষ হয় না। ‘আফটারনুন
প্রেপ’-এর পর ‘গেমস’। আজ খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মাথার মধ্যে রুনু এসে ভর করে। রুনু
একটা ভেজাল করে ফেলেছে। অন্য ছেলেকে লেখা একটা চিঠি চলে গেছে তার হবু বরের কাছে।
বর এখন রুনুকে বিয়ে করতে চায় না। সে চায় ঝুনুকে। ঝুনুও রাজি হয়ে যায়। রুনুর কী হবে
তাহলে? গেমস শেষ হয়। মাগরিবের নামাজ শেষে আবার ক্লাসরুমে ফিরে যাই এবং বইটি শেষ
করি।
বই শেষ করে আর কিছু ভালো লাগে না। রাবেয়া আপার
জন্য এক অপরিসীম মায়া জমে মনে। তাঁর শেষ চিঠিটি আবার পড়ি। বারবার পড়ি। মাঝে মাঝে
টের পাই, গাল বেয়ে পানি পড়ছে। এ সময় এমনটি প্রায়ই হতো। খুব সহজেই কান্না এসে যেত।
নিঃশব্দে চোখ মুছে শঙ্খনীল কারাগার-এর
জ্যোৎস্নার চাদরে ডুব দিই। লেখক বইটি শেষ করেছেন এক রাতের বর্ণনা দিয়ে। এই বর্ণনার
মধ্যে কাব্য আছে। গদ্য পড়তে পড়তে মনে হয় কবিতা পড়ছি :
গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রায়ই। ছাড়াছাড়া
অর্থহীন স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ জেগে উঠি।...মাথার কাছের জানালা মনে হয় সরে
গিয়েছে পায়ের কাছে।
কোনো কোনো রাতে অপূর্ব জোছনা হয়। সারা ঘর নরম
আলোয় ভাসতে থাকে। ভাবি, একা একা বেড়ালে বেশ হতো। আবার চাদর মুড়ি দিয়ে নিজেকে
গুটিয়ে ফেলি। যেন বাইরের উথাল পাথাল চাঁদের আলোর সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই।
মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। এক ঘেয়ে কান্নার সুরের
মতো সে শব্দ।...
ক্লাসে আমার পাশে বসত ফজলে। ফজলেও খুব বইপোকা।
সে বলল, এই লেখকের আরও দুটো বই আছে লাইব্রেরিতে। একটির নাম নন্দিত নরকে, আরেকটি তোমাদের জন্য
ভালোবাসা।
দুইদিনের মাথায় নন্দিত নরকে পড়া হয়ে যায়। পর পর দুটি বই পড়ার পর মাথা আরও ঘুরপাক
খায়। দুই বইতেই একই চরিত্র। এখানেও রাবেয়া, মন্টু, খোকা।
নন্দিত
নরকের
কাহিনিটা বেশ জটিল। বোবা, অবিবাহিতা বড় বোনের পেটে বাচ্চা আসার কারণে মন্টু বাড়ির
গৃহশিক্ষককে খুন করে। কী বিশ্রী অবস্থা! মন্টুর ফাঁসি হয়ে যায়। ওর জন্য খুব মায়া
লাগে। মন্টু তো আমার বয়সীই হবে।
নন্দিত
নরকে
আসলে লেখকের লেখা দ্বিতীয় বই, কিন্তু প্রকাশের দিক থেকে প্রথম। বেরোয় ১৯৭২ সালে।
এই বইয়ের পেছনের মলাটে দেখি বেশ কজন বুদ্ধিজীবী মন্তব্য লিখেছেন। মনে পড়ে, ড. আহমদ
শরীফ তাঁর ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মননে প্রাচীন দ্রষ্টা,
মেজাজে জীবন-রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট
জীবনশিল্পী হবেন—এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।’
এরপর পড়ি তোমাদের
জন্য ভালোবাসা। ভিন্ন গ্রহ থেকে এক মানুষ আসে পৃথিবীতে। ফজলে বলে, ওটা হচ্ছে
‘সায়েন্স ফিকশন’। আমি প্রথম জানলাম যে সায়েন্স ফিকশন নামেও একধরনের উপন্যাস আছে। তোমাদের জন্য ভালোবাসাটা খুব বেশি ভালো
লাগল না। আমি শঙ্খনীল কারাগার আর নন্দিত নরকে নিয়েই মজে থাকি।
তিনটি বই পড়া শেষ হলে প্রায় প্রতিদিনই
লাইব্রেরিয়ান শামসু ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘লাইব্রেরিতে হুমায়ূন আহমেদের আর কোনো বই
আছে?’
“ ” - Rifat
“ ” - Sadik Emran