রাজনীতিতে
গুণগত পরিবর্তনে মিডিয়ার ভূমিকা
সবাই জানেন, দেশে এখন একটা ক্রান্তিকাল চলছে। কেন
এই ক্রান্তিকাল, তার কারণও সবার জানা। আগামী তিন মাস দেশের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বছর শেষে আমরা সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন পাব। অথবা
আবার একটা রাজনৈতিক সংঘাতে দেশ জড়িয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত কী হতে যাচ্ছে তা এখনো
অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা তাদের মতামত দিক। আমার বক্তব্য ভিন্ন বিষয়ে।
১/১১ এর পর থেকে আমরা কয়েকটি কথা বারবার বলছি এবং
শুনছি। তা হলো : ১) রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে, ২) শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিবাজদের
বিচার ও শাস্তি হতে হবে, ৩) রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, কালো টাকা ও পেশীশক্তির দাপট বন্ধ
করতে হবে, ৪) দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ৫) দলের মধ্যে একনায়কত্ব বা
পরিবারতন্ত্রের অবসান হতে হবে ইত্যাদি। এসব দাবি বা প্রত্যাশার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে
এমন সচেতন লোকের সংখ্যা খুব কম। এমনকি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে গোপন ভোট হলে দলের বেশিরভাগ
সদস্য এগুলোর পক্ষেই ভোট দেবেন বলে আমার ধারণা। ২০০৭-এ ১/১১ এর যারা উদ্যোক্তা ছিল,
তারা প্রকারান্তরে জনগণের এসব দাবিই পূরণ করার চেষ্টা করবেন বলে ধারণা দিয়েছিলেন। কিন্তু
২০০৮ এর শেষে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার এসব দাবির অনেকগুলোই পূরণ করতে পারেনি।
যদিও সরকার সুষ্ঠু ভোটার তালিকাসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করেছেন। যেসব কাজ সরকার
করেছেন সেগুলোর জন্য সরকার প্রশংসার দাবিদার। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া এ
ব্যাপারে সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে।
কিন্তু যে কয়েকটি বিষয় আমি শুরুতে উল্লেখ করেছি
সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আমি মনে করি উল্লেখিত কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্যে
আমাদের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সরকারকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা করেনি। আমি দলীয় মিডিয়াকে এজন্যে
অভিযুক্ত করছি না। তারা তো তাদের প্রভুদের স্বার্থই দেখবে। কিন্তু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ
মিডিয়া বলে যারা নিজেদের দাবি করে তারা এ ব্যাপারে বলিষ্ঠভাবে জনমত গঠন করতে ব্যর্থ
হয়েছে। তথ্যবহুল রিপোর্ট প্রকাশ করা আর কিছু কিছু নীতির সপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়া এক
কথা নয়। বিভিন্ন পত্রিকা রাজনৈতিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, পরিবারতন্ত্র, রাজনীতির
দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এটা কম প্রশংসাযোগ্য নয়। কিন্তু
উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিন কঠোর কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি। ১/১১-এর
পর এ ব্যাপারে পরিকল্পিত জনমত গঠনের একটা বড় সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আমাদের স্বাধীন মিডিয়া
সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি। বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যারা সমালোচক তাদের কাছে পত্রিকার
মূল্যবান জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। আমাদের অনেক কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী পরোক্ষভাবে আওয়ামী
লীগ ও বিএনপির মন জুগিয়ে চলেন। তাদের পক্ষে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, পরিবারতন্ত্র,
দলীয় একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলা বা লেখা সম্ভব নয়। পত্রিকারগুলোর উচিত ছিল যারা
কোনো দলের মন জুগিয়ে চলে না তাদের সংঘবদ্ধ করা ও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে
দৃঢ় অবস্থান নেয়া। কী কী প্রচলিত ব্যবস্থা বহাল থাকলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা
সম্ভব হবে না তা আলাপ আলোচনার (গোল টেবিল) মাধ্যমে চিহ্নিত করা উচিত ছিল। এসব ব্যবস্থা
দূর করার জন্যে জনমত সৃষ্টি উচিত ছিল। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সচেতন মানুষের
মতামত সংগ্রহ করা উচিত ছিল। সরকারকে এভাবে সহায়তা করা যেত। আমাদের বুঝতে হবে, বর্তমান
সরকারের পক্ষে ছাত্র যুবকদের কোনো লাঠিয়াল বাহিনী নেই। যারা পেশীশক্তির দাপটে সরকারকে
প্রভাবিত করবে। একমাত্র স্বাধীন মিডিয়া হতে পারত সরকারের সহায়ক শক্তি। স্বাধীন মিডিয়া
সেই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
শুধু সেই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বললে কম বলা
হবে। দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির স্রষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি মিডিয়া সহানুভূতিশীল
ভূমিকাও পালন করেছে। দলীয় ক্যাডারদের মতো অনেক মিডিয়াও দুর্নীতির মামলাকে মনে করেছে
“এসব নেহাতই অভিযোগ, এখনো প্রমাণিত হয়নি।” অথচ জোট সরকারের আমলে এসব মিডিয়াতেই এই নেতাদের
সন্ত্রাস ও দুর্নীতির সাতকাহন প্রকাশিত হয়েছিল। এখন সেই দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসীদের “মানবাধিকার”
রক্ষার জন্যে একই মিডিয়া কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছে।
আমাদের দলনিরপেক্ষ মিডিয়া রাজনীতি নিয়ে অদ্ভুত
আচরণ করে। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার সময় তারা দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে
সোচ্চার থাকে। মিডিয়ার দাবি থাকে : “এদের এখনই গ্রেফতার করা হোক।”
আবার গ্রেফতার করা হলে এদের জামিন ও মুক্তির জন্যে
মায়াকান্না জুড়ে দেয়। সরকার মিডিয়ার কোন কথাটা শুনবে?
ছাত্র রাজনীতির নামে গত দুই দশক এদেশে কী কাণ্ড
হয়েছে সবই আমরা জেনেছি মিডিয়ার মাধ্যমে। আমাদের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার
স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ও হলে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত ক্ষমতাসীন দলের
ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষক সমিতি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করত
ক্ষমতসীন দলের পেশাজীবী দলীয় ক্যাডাররা। তাদের কাছে মন্ত্রীরাও অসহায় থাকতেন। এসব কাহিনী
শুনিয়েছে আমাদের মিডিয়া। অথচ নির্বাচন কমিশন যখন রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের স্বার্থে
দলের কোনো অঙ্গ সংগঠন না রাখার বিধান প্রস্তাব করেছে তখন মিডিয়ার কোনো সোচ্চার ভূমিকা
দেখা গেল না। যেন “থাকলেও ভালো না থাকলেও মন্দ না।” ব্যাপারটা কী এতই সরল ও সহজ? মিডিয়া
নীতিনির্ধারক ও স্বাধীন কলাম লেখকরা (দলীয় নয়) কী জানেন না, এদেশে রাজনীতিতে গুণগত
পরিবর্তন আনতে হলে কোনো দলের লেজুড় ছাত্র ও পেশাজীবী সংগঠন রাখা যাবে না। এই বিধান
নিয়ে কী আপস করার সুযোগ আছে? তবু আমাদের নিরপেক্ষ মিডিয়া এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে
জনমত সংগঠন করতে কোনো জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। গত ২৫ আগস্ট হাসপাতালে তারেকের আহত
হবার সংবাদে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদল কর্মীরা ঢাকার বুকে যে সন্ত্রাসী কাণ্ড ঘটিয়েছে তা নিয়েও
মিডিয়া বলিষ্ঠভাবে উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেনি। একটা সম্পাদকীয় রচনা এজন্যে যথেষ্ট
নয়। এই ঘটনা আগামী দিনের আরো বহুগুণ বেশি সন্ত্রাসী ঘটনার ইঙ্গিত বহন করে। মিডিয়া কি
তা জানে না? জানে।
দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত নেতারা গত এক মাসে
যেভাবে জামিন নিয়ে মহোৎসবে বেরিয়ে এসেছে তা কি ন্যায় বিচার বা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার
প্রতিফলন? সাম্প্রতিক এই “জামিন” ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা,
স্বাধীনতা, অতীতের বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি, বিচারকদের নিরপেক্ষতা ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক
আলোচনা করার সুযোগ ছিল। সেই সুযোগ মিডিয়া এখনো গ্রহণ করেনি।