ওপর আসমান থেকে ছিটকে
আসা বজ্রশব্দের কুণ্ডলী যেন নীলুর মাথায় ঝপাৎ পড়ে আচমকা তার গতি থামিয়ে দেয়। একটি
উজ্জ্বল দিনকে মুহূর্তেই নিভিয়ে আচমকা বৃষ্টি নামে। বাতাসের উড়ন্ত ঝাপটার সাথে সাথে
বিক্ষিপ্ত জলকণা— নীলু একরকম দৌড়েই রাস্তার পাশের একটি বারান্দায় গিয়ে ওঠে। চুলে,
মুখে টুকরো জল। আধভেজা শাড়ি, ভ্যানিটি ব্যাগ সব ছাপিয়ে পামট্রিই প্রবল হয়ে ওঠে। বারান্দার
সামনে ন্যাড়া নিঃসঙ্গ পামট্রি। বৃষ্টির তোড়ে থিরথির কাঁপছে। বিদ্যুৎ ঝলকের সাথে সাথে
আলোর ঝলকে চমকে চমকে উঠছে। “দ্যা স্কাই ইজ ক্রাইং”─ অপজিটের জানালা
ফুঁড়ে এরিক ক্ল্যাপটন-এর তারুণ্য নীলুর রক্তস্রোত প্রবল করে। পিছু হটতে হটতে একসময়
দেয়ালে পিঠ ঠেকে। স্যাঁতসেঁতে পায়ের পাতা থেকে চামড়ার স্যান্ডেল খুলে বারান্দায় রাখতেই
ঠাণ্ডার স্পর্শ। বড় অকৃত্রিম ভালোলাগা। সামনে শূন্য পামট্রি, চারপাশে বাতাসের বৃষ্টির
পাশাপাশি ভাঙ্গা গলায় পুরনো ক্ল্যাপটন...। খসখসে চামড়া টান হয়ে ওঠে।
আশ্চর্য! কি অসভ্য ওই
ইংলিশ মিউজিক, বিকৃত মানুষের বর্বর চিত্তকার যেন, বলুন কি হবে এই সমাজের? শুধু ভায়োলেন্স,
অপসংস্কৃতি, বোগাস সব চুলকানো ডান্স, কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা, আর্টফিল্ম কোথায়
যে ছবি দেখব?─
আড্ডায় এইসব বুলি কপচে
টানটান চামড়া ঝুলে গেছে। প্রায়ই আড্ডার গরম চা জল হয়ে ওঠে। অথচ এই যে বৃষ্টির তোড়ে,
অপজিটে গিটার হাতে ক্ল্যাপটন। নীলুর পুরো সত্তা জেগে উঠছে। লুপ্ত প্রায় ক্ষিপ্ৰগতি
ও তারুণ্যকে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে রুচিবান উপস্থাপনের যে মুখস্থবুলিগুলো সে আউড়ে যায়,
এর সবটাই সত্য? অধিকাংশ? কিংবা অর্ধেক? না, সামনের ন্যাড়া পামট্রিই গোলমাল বাধাচ্ছে।
এমন বেখাপ্পা, খাপছাড়া, বেঢপ! পাশাপাশি দুটো থাকলেও বরং দারুণ হতো। নীলু আরও অনেকক্ষণ
দাঁড়াতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ন্যাড়া দুটোকে দেখত।
ঘড়ি দেখে সহসা নীলু
যেন অনভ্যস্ত প্রবাসী ক্ল্যাপটন থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে।
দ্রুত আঙুলের ফাঁকে স্যান্ডেল
গলিয়ে বৃষ্টির নিচেই নেমে আসে। দুহাত ওপরে তুলে বৃষ্টিকে ঠেকানোর হাস্যকর চেষ্টাসহ
ভিজতে ভিজতেই বারান্দায়। নিজেকে ঝেড়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়।
দীর্ঘ সময় হেঁটে হেঁটে ফের ক্লান্ত চোখে নীলু সময় দেখে, আশ্চর্য প্রকৃতির ধরন, মহারাস্তায়
যেতে যেতেই নীলু টের পায়, জলশুষে টসটসে সূর্যটা রীতিমতো গলগলিয়ে উঠেছে। হু-হু রোদ বাতাসের
ঝাপটে, যেন প্রায় ধাক্কা খেয়েই রিকশায় ওঠে। রিকশা চলতে থাকে। কড়া হয়ে উঠতে থাকা রোদকে
জাগিয়ে দিয়ে কিছু আগের একফোঁটা শীতও খুব একচোট ঘুম দিচ্ছে। সামনে গর্জমান নগরী। নীলুর
মস্তিষ্কে না আলো, না ছায়া... কিচ্ছু খেলে না। ভেতরে এক সময় এমন প্রশ্নও উত্থিত হয়,
কেন যেন বেরিয়েছি?
হঠাৎ পেছন থেকে একটা
গাড়ি ধাক্কা দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলু পাশের রাস্তায় ছিটকে পড়ে। মুহূর্তে সে যেন
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মর্তে ভূমিষ্ঠ হয়। গাড়ি থেকে নেমে আসে ইফতেখার। মানুষের ভিড়
জমার আগেই ইফতেখার নীলুর হাত ধরে টেনে তোলে।
ও গড! কিছু হয় নি তো
আপনার? ইফতেখার মহাবিব্রত, নাহ্। এই ড্রাইভারটা আমার চৌদ্দটা বাজিয়ে ছাড়বে।
একজন মারমুখী হয়ে এগিয়ে
আসে, মহিলারে মাটিতে ফালায়া অহন ড্রাইভাররে দোষ দিতাছেন?
অন্যজন বলে, ভালা ড্রাইভার
রাখনের দায়িত্ব কার? আপনের না আমাগোর...? বলতে বলতে জানালা দিয়ে ড্রাইভারের শার্টের
কলার চেপে ধরে। ওই ব্যাটা! বাইর হয়া আয়...।
নীলু ইফতেখারের হাত চেপে
ধরে উঠে দাঁড়ায়। এরপর চারপাশে ভনভন মাছির মতো কোরাসরত মানুষদের হঠাৎ স্তব্ধ করে— আরে
আপনারা থামুন তো? বলে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ইফতেখারকে ইশারা করে, আপনি ভেতরে
আসুন তো।
ইফতেখার হতভম্ব হয়ে ভেতরে বসে। নীলু বলে, চলুন। গাড়ি
স্টার্ট দেয়।
ভিন্ন একজন বলে, যাহ্
বাবা! একজন আরেকজনের চিনা মনে হইতাছে।
গাড়িতে বসেও নীলুর মাথার
মধ্যে রঙহীন রঙধনুর নৈর্ব্যক্তিক সাত রঙ ঘাই খেয়ে খেয়ে নিজেকে যেন এক ছোঁ-এ শূন্য দ্বীপে
নিয়ে ফেলে। যেখানে সে ছাড়া আর কেউ নেই। কী এক ব্যথার টানে নীলু উবু হয়ে পায়ের গোড়ালি
চেপে ধরে। রক্ত বেরোচ্ছে।
ইফতেখার হতভম্ব, আশ্চর্য মেয়ে তো আপনি! মানে এইভাবে
হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে... মানে...। বলতে বলতে পেছন থেকে টিস্যু বের করে এগিয়ে দেয়
নীলুর দিকে। আই অ্যাম ভেরি সরি... কিন্তু...।
লাল-নীল আলোর বলয়, ছায়া
কিংবা ছায়াহীনতা ভেদ করে এইবার নীলু স্বচরিত্রে ইফতেখারকে বলে, ওখানে আর কিছুক্ষণ আপনি
থাকলে পুলিশ... মানুষ নানা হুজ্জোতের মধ্যে আপনাকে পড়তে হতো। ড্রাইভার! একটা ডিসপেনসারিতে
চলুন...।
ডাক্তার পায়ে ব্যান্ডেজ
বেঁধে বলে, চিন্তার কিছু নেই। বড় কিছু হয় নি। ক’দিনেই সেরে যাবে।
ইফতেখারের বিস্ময় কাটে
না। সে নীলুর মলিন কিন্তু প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বপূর্ণ মায়ায় ভরা মুখের দিকে তাকায়— সত্যিই
ভীষণ আশ্চর্য মেয়ে আপনি! অমন করে ইনস্ট্যান্ট সিদ্ধান্ত নেয়া, সহজ কথা!
নীলু হাসে, আমি তখন যেটা
জরুরি মনে করেছি, তা-ই করেছি। এখন দয়া করে আপনি যদি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন, উপকৃত হবো।
অবশ্যই, বিব্রত ইফতেখার
নীলুর হাত ধরে বেড থেকে নামায়।