logo
0
item(s)

বিষয় লিস্ট

সৌমিত্র দেব এর আগুন পিপাসা

আগুন পিপাসা
এক নজরে

মোট পাতা: 102

বিষয়: সমকালীন উপন্যাস

সেলুলয়েডের ফিতের মতো ভোর। ঘন কুয়াশা ঢাকা আকাশ। শান্ত এক ফালি রোদের রেখা রেললাইনের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। লাজুক রোদের আলোয় শিশিরভেজা নিসর্গের দিকে তাকিয়ে বারবার আনমনা হয়ে পড়ছিল আফ্রোদিতি। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জানালার কাচটা আগেই নামিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার খানিকটা তুলে ধরলো। মনোযোগ দিল সদ্য কেনা ‘পাক্ষিক জয়তী’ ম্যাগাজিনের পাতায়।

সেই সাত-সকালে ভোরের ট্রেন ধরার জন্য কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছেছিল। ঠিক সময়েই ছেড়েছে আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস। তবে পৌনে একটার আগে শ্রীমঙ্গল পৌঁছবে না। সেরকমটিই বলে দিয়েছেন বড় চাচা। এই দীর্ঘ সময়টুকু পত্রিকার পাতায়, রেললাইন সংলগ্ন নিসর্গে অথবা মনের গহনে ডুব দেয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে। শুনেছিল বাসে এখন সময় অনেক কম লাগে। তবু রেলভ্রমণ অনেক বেশি নিরাপদ। তাছাড়া ট্রেনের ঝিকঝিক ছন্দ তার খুব ভালো লাগে। ভাগ্যিস, সময়মতো ছেড়েছিল ট্রেন। অপেক্ষা খুব বিরক্তির একটা ব্যাপার। বন্ধু হোক আর যানবাহনই হোক, কারো জন্যই অপেক্ষা ভালো লাগে না। আর স্টেশনে যা ভিখিরির উৎপাত! শুধু স্টেশনেই বা বলি কেন, রাজপথে-ফুটপাতে কোথায় নেই ওরা। শহরের সবখানেই এখন ছিন্নমূল মানুষের ভিড়! সবখানেই দারিদ্র্যের বীভৎস চেহারা। এসব ভাসমান মানুষের চাপে আমাদের দেশ ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

জীবনে এই প্রথম সে একা একা বাড়ি যাচ্ছে। মনে পড়ছে বন্ধু রাজুর কথা। রাজু বলে, গ্রামের বাড়ি যাওয়া মানে হচ্ছে শেকড়ের কাছে ফেরা। কিন্তু শেকড় কাকে বলে সেটা সে ঠিক বোঝে না। আফ্রোদিতি বড় হয়েছে ঢাকায়। ওর জন্মের আগেই ধানমন্ডিতে বাড়ি করেছেন বাবা। সে হিসেবে ওটাইতো তার শেকড়। স্বাধীনতার পর যারা ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠে, ওর বাবা তাদেরই একজন। নাগরিক কোলাহলের মধ্যে বেড়ে উঠেছে সে, আর তার সঙ্গেই যেন তিলোত্তমা হয়ে উঠেছে ঢাকা শহর। স্কুলে লম্বা ছুটি পড়লে বাবা ওকে শহর থেকে অনেক দূরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। সেটাই কি প্রকৃত শেকড়? সে জানে না। গ্রামের বাড়ির কথা মনে হলেই ভেসে ওঠে টুকরো কিছু ছবি। একটা বড় দিঘি, আমগাছ, জামগাছ, কাঁঠালগাছ, সুপারিবাগান। আর উর্বরা ধানি জমি। মোল্লাবাড়ির পুরনো মসজিদ। গ্রামের এক প্রান্তে বৈষ্ণবদের আখড়া। সেখানে চাচাতো ভাইদের সঙ্গে মিলে লুকিয়ে গান শুনতে যেতো। মনে পড়ে শ্মশ্রু–গুল্ফ শোভিত দীর্ঘদেহী দাদাজানের কথা। সুবেহ সাদেকে দাদাজান সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। সেই তেলাওয়াত শুনে কতদিন তার ঘুম ভেঙে গেছে। আবছা হয়ে গেছে ছবিগুলো, তবু মনে পড়ে দাদির কথা। বুড়ি তার ফোকলা দাঁতে পান চিবুতে চিবুতে কত যে কেচ্ছা শোনাতো। আফ্রোদিতির মনের পুকুরে সেসব ভেসে উঠছে আর ট্রেনের ঝাঁকুনিতে মৃদু আলোড়ন তুলে হারিয়ে যাচ্ছে।

অনেক দিন হয় বুড়ো-বুড়ি দু’জনেই মারা গেছে। তাদের কবরটা পর্যন্ত জেয়ারত করতে পারে নি সে। আজ থেকে দশ বছর আগে বড় চাচার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু সেবারে একদম ভালো লাগে নি তার। সমবয়সীদের সমমনা মনে হয় নি। বাড়ির নৈসর্গিক সৌন্দর্য অথবা চাচা-চাচীদের আন্তরিক আদর-যত্ন কোনো কিছুই বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে নি তাকে। সেখানে টিভি নেই, কেরাম বোর্ড নেই, গল্পের বই নেই। কী নিয়ে সে সময় কাটাবে? প্রতিটা মুহূর্ত অসহ্য ঠেকেছে। মনে হয়েছে ওটা একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। এই ক’বছরে তার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হয়েছে। কিন্তু বাড়ি মুখো আর যাওয়া হয় নি। গ্রামের বাড়িটাই যে আসল শেকড় সেটা তাকে বুঝিয়েছে রাজু। ওর কারণেই সে আইনের ওপরে পড়াশোনা করেও আকৃষ্ট হয়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতি। শুনেছে গ্রামের বাড়িতেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেখানে তেমন কেউ আর এখন থাকেন না। সবাই শহরমুখী হয়ে পড়েছেন। ছোটচাচা উকিল হিসেবে মৌলভীবাজার শহরে খুব নাম করেছেন। শহরের কলিমাবাদ এলাকায় তার নিজস্ব বাড়ি হয়েছে। আফ্রোদিতির বাপ-চাচারা মোট তিন ভাই। ওর বাবা ভাইদের মধ্যে মেজ। একমাত্র বড় চাচাই এখনো গ্রামের বাড়িতে থেকে সবকিছু দেখাশোনা করেন। স্কুলমাস্টার হিসেবে রিটায়ার করেছেন। আর মেজ ভাই—আফ্রোদিতির বাবার কথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি ব্যবসা করে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একমাত্র বড় চাচাই ছোট ভাইদের খোঁজখবর নেন। তাদের বাড়িতে যাতায়াত করেন। সপ্তাহখানেক আগে একটা বিশেষ কাজে তিনি তাদের বাসায় এসেছিলেন। অনেকদিন পর বাড়িটা একবার ঘুরে আসার জন্য তিনি অনুরোধ করেন আফ্রোদিতিকে। বড় চাচার প্রস্তাবে এবার আর ‘না’ করতে পারে নি সে। তবে বাড়ি যাওয়ার পেছনে শুধু বড় চাচার আমন্ত্রণ নয়, তার নিজেরও একটা উদ্দেশ্য আছে। সে কারণে নিজের মতো করে এবার বাড়ি যাওয়ার একটা কর্মসূচী তৈরি করেছে সে। প্রোগ্রাম অনুযায়ী আজ একাই ভোরের ট্রেনে রওনা দিয়েছে। শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে তাকে অভ্যর্থনা করে মৌলভীবাজারে নিয়ে যাবেন ছোট চাচা। সেখানে দু’দিন থাকার পর তাকে কমলগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন বড় চাচা।

সংশ্লিষ্ট বই

পাঠকের মতামত
রিভিউ লিখুন
রিভিউ অথবা রেটিং করার জন্য লগইন করুন!