একাত্তরের যীশু
দক্ষিণের শহর আর গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে পাঞ্জাবি সৈন্যরা ধীরে ধীরে উত্তর দিকে
এগিয়ে আসছিল। খবরটা শুনে মে মাসের প্রথম থেকেই গ্রামের লোক আরো উত্তরে শালবনের দিকে
সরে যেতে লাগলো। অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে কুচবিহার আর পশ্চিম দিনাজপুরে চলে গেল।
সীমান্ত বেশি দূরে নয়। অনেকে ওপারে গিয়েও নিয়মিত যাওয়া আসা করছিল।
জুনের মাঝামাঝি যখন সবাই নদীর ওপারের ছোট্ট শহরটাকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখলো, তখন
যারা যাবার তারা একেবারেই চলে গেল। থেকে গেল জামাত, মুসলিম লীগের কিছু দালাল আর কয়েকজন
বুড়ো। গির্জার ঘন্টা টানতো বুড়ো ডেসমন্ড ডি রোজারিও। সে ছিল থেকে যাওয়া বুড়োদের একজন।
এতদিন ফাদার মার্টিন ছিল গির্জায়। যশোরে পাঞ্জাবিরা মিশনারিদের
মেরেছে— এই খবর শুনে তিনিও কিছুদিন আগে শহরে চলে গেছেন। বুড়ো ডেসমন্ডকে ডেকে বলেছিল, ‘উহারা মিশনারিদিগকেও হত্যা
করিতেছে। আমি শহরে যাইতেছি। তুমি বিপদ দেখিলে ইন্ডিয়া চলিয়া যাইও। ইন্ডিয়ার মানুষ আমাদের
অসহায় মানুষদিগকে আশ্রয় দিয়াছে। ঈশ্বর উহাদের মঙ্গল করিবেন।’ এই বলে ফাদার বুকে ক্রস
এঁকেছিল।
বুড়ো ডেসমন্ড মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে দাগ
কাটতে কাটতে জবাব দিয়েছিল ‘মুই আর কুণ্ঠে যাবেক ফাদার।’
অনেক ভেবেছিল ডেসমন্ড বুড়ো। আসলে সে যাবেইবা কোথায়! তার স্বজাতি
সাঁওতালরা যখন যেখানে খুশি অনায়াসে চলে যেতে পারে। ওদের রক্তের সকল অণুতে মহুয়ার মতো
মিশে আছে যাযাবরের নেশা। কিন্তু ডেসমন্ডের সেই নেশা কেটে গেছ বহু বছর আগে। নিজেকে এখন
মনে হয় ঝুরি নামানো বুড়ো বটগাছের মতো, সারা গ্রামে যার শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামে যখন এই গির্জা প্রতিষ্ঠিত হলো, ডেসমন্ড তখন বারো বছরের
বালক। পাদ্রী ছিল ফাদার নিকোলাস। তিনিই ডেসমন্ডকে দীক্ষা দিয়েছিল। বলেছিল— ‘প্রভুর স্থান ছাড়িয়ে কোথাও
যাইও না। প্রভু তোমাকে রক্ষা করিবেন।’
সেই থেকে ডেসমন্ড এই গির্জায় পড়ে আছে। গির্জার পাশে সবুজ ঘাসের
আঙিনা। দেয়ালের ওপাশে সারি সারি কবর। সবুজ আঙিনা আর কবরের মাঝে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের
গায়ে লাগানো ছোট্ট দু’টো ঘর। ছাদটা লাল টালির। দেয়ালগুলো সাদা চুনকাম করা। এই ঘর দু’টো ডেসমন্ডের। সারাদিন সে
এখানেই থাকে, আর গির্জার ঘন্টা বাজায়। ওর মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র কাজের দায়িত্ব
প্রভু ওকেই দিয়েছেন।
আগে ডেসমন্ড সকালে গির্জার বাগানে কাজ করতো। গির্জার ভেতরের
ঝাড়ামোছাগুলো শেষ করে রাখতো। বিকেলে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতো। প্রভু ছোটদের ভালোবাসতেন।
বহুদিন বাইবেল থেকে ফাদাররা পড়ে শুনিয়েছেন, “যীশু কহিলেন, শিশুদিগকে আমার নিকট আসিতে দাও। বারণ করিও না।
কারণ স্বর্গরাজ্য এইমত লোকদেরই।”
প্রায় জনশূন্য গ্রামগুলোতে মানুষের সাড়াশব্দ একেবারেই নেই। দু’একজন বুড়ো, যারা এখনো গ্রামে
আছে, তারা ছোটদের মতো সারা গ্রাম মাতিয়ে রাখতে পারে না। বুড়ো ডেসমন্ডের বুকে শুধু যন্ত্রণার
ঢেউ উত্তাল হয়। নিবির দাদু, হরিপদর খুড়ো যখন এসে শহরে শত্রু সৈন্যদের অত্যাচারের কথা
বলে, ডেসমন্ড তখন বুকে জমে থাকা কান্না থামিয়ে রাখতে পারে না।
সারাটা জুলাই মাস বুড়ো ডেসমন্ড একা একা কাটালো। বাগানের কাজে
আগের মতো উৎসাহ পেতো না। তবু সকালটা গির্জার কাজে ব্যস্ত থাকতো। বিকেলগুলো ওর কাছে
ভয়াবহ মনে হতো। গ্রামের সেই উচ্ছল ঝর্ণার মতো ছেলেমেয়েগুলো কোন শয়তানের যাদুবলে কোথায়
কীভাবে যে হারিয়ে গেল— ডেসমন্ড যতো ভাবে ততো তার বুকে দুঃখের পাহাড় জমে। গির্জার প্রাঙ্গণে
কতগুলো শিরিষ গাছ ছিল। অন্য সময়ে গাছগুলোতে রঙবেরঙের পাখির মেলা বসতো। এখন পাখিরা আর
শিরিষের ডালে গান গেয়ে ছুটোছুটি করে না। আঙিনার সবুজ ঘাসের কার্পেটে প্রজাপতিরা নানা
রঙের নকশা আঁকে না। শিরিষের পাতা গলিয়ে বিকেলের মরা রোদ গির্জার গায়ে জড়িয়ে থাকে। বিশাল
এক শূন্যতা সারা গ্রাম জুড়ে হা হা করে কাঁদতে থাকে। বাতাসকে মনে হয় কোনো ডাইনীর অভিশাপের
নিঃশ্বাস। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বুড়ো ডেসমন্ড শুধু ছটফট করে। ভাবে ঈশ্বর কেন ওকে এই
নরকে ঠেলে দিলেন!
যখন সময়গুলো একেবারেই অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন ডেসমন্ড জানালার তাকের
ওপর থেকে, ফাদার গাঙ্গুলীর দেয়া ‘মথি লিখিত সু-সমাচার’খানা নামিয়ে আনে। ভালো মতো পড়তে পারে না ডেসমন্ড। চোখে ঝাপসা
দেখে। তবু কোনো রকমে বানান করে জোরে জোরে পড়ে— “ইতিমধ্যে পিতর বাহিরের প্রাঙ্গণে বসিয়াছিল। আর একজন দাসী তাঁহার
নিকটে আসিয়া কহিল, তুমিও সেই গালীলীয় যীশুর সঙ্গে ছিলে। কিন্তু তিনি সকলের সাক্ষাতে
অস্বীকার করিয়া কহিলেন, তুমি কি বলিতেছ আমি বুঝিতে পারিলাম না। তিনি ফটকের নিকট গেলে
আরেক দাসী তাঁহাকে দেখিয়া সেস্থানের লোকদিগকে কহিল, এ ব্যক্তি সেই নাযারথীয় যীশুর সঙ্গে
ছিল। তিনি আবার অস্বীকার করিলেন, দিব্য করিয়া কহিলেন, আমি সে ব্যক্তিকে চিনিনা। অল্পক্ষণ
পরে যাহারা নিকট দাঁড়াইয়াছিল তাহারা আসিয়া পিতরকে কহিল, সত্যই তুমি তাহাদের একজন। কেননা
তোমার ভাষা তোমার পরিচয় দিতেছে। তখন তিনি অভিশাপপূর্বক শপথ করিয়া বলিতে লাগিলেন আমি
সে ব্যক্তিকে চিনি না। তখনই কুকুড়া ডাকিয়া উঠিল। তাহাতে যীশু এই যে কথা বলিয়াছিল, কুকুড়া
ডাকিবার পূর্বে তুমি তিনবার আমাকে অস্বীকার করিবে, তাহা পিতরের মনে পড়িল। এবং তিনি
বাহিরে গিয়া অত্যন্ত রোদন করিলেন।”
ডেসমন্ড যতোবার বাইবেল পড়ে যীশুখৃস্টের ক্রুসবিদ্ধ হবার ঘটনার
কথা ভাবে, ততোবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। তবু সে জোরে জোরে বাইবেল পড়ে। ওর মনে হতো বাইবেলের
পবিত্র শব্দগুলো শয়তানের মতো ভয়ঙ্কর নীরবতাকে তাড়া করে ফিরছে। গির্জার প্রাঙ্গণে অন্ধকার
নামা পর্যন্ত ডেসমন্ড বাইবেল পড়ে। নীরবতাকে ও ভয় করে, একই সঙ্গে ঘৃণাও করে।
আগস্টের শেষে এক বৃষ্টিভেজা রাতে ওরা কয়েকজন এল বুড়ো ডেসমন্ডের
ঘরে! হারিকেনের ম্লান আলোয় ডেসমন্ড তখন গির্জার আইকন পরিষ্কার করছিল। দরজায় হালকা পায়ের
শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো। দেখলো তিনটি ছেলে, বৃষ্টিতে ভেজা সারা শরীর, চুলের ডগা
বেয়ে মুক্তোর দানার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। ওদের উজ্জ্বল চোখগুলো হারিকেনের ম্লান আলোতেও
চকচক করছিল। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ডেসমন্ডের মনে হলো, ওরা যেন তিনজন
দেবদূত, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। তারপর সে এতো বেশি অভিভূত হয়ে গেল যে, আর কোনও কথাই
বলতে পারলো না।
ওরা তিনজন একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। একজন একটু হেসে বললো,
‘আমরা আজ রাতে তোমার এখানে থাকবো ডেসমন্ড দাদু।’
আরেকজন বললো, ‘তোমাদের গাঁয়ের দাশু খুড়ো বলেছে, তুমি খুব ভালো লোক।’
স্বর্গের দেবদূত ওর কাছে এসেছে, ওর ঘরে থাকতে চাইছে— ডেসমন্ড কি বলবে সহসা কিছুই
ভেবে পেলো না। তারপর এলোমেলো ভাবে বললো, ‘হায় হায়, থাকতি কেনে দিবেক নেই। তোমাদের কষ্ট হতিছে বাছা। আগুনের
ধারে বস। সব ভিজ্যে গেছে।’
হাতের ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রেখে ওরা ছোট্ট উনুনটির পাশে গিয়ে
বসলো। বললো, ‘দাশু খুড়ো তোমার কথা অনেক বলেছে ডেসমন্ড দাদু। বলেছে, তুমিই
আমাদের সাহায্য করতে পারো। তোমার মতো ভালো লোক এ গাঁয়ে আর নেই।’
বিরাশি বছরের বুড়ো ডেসমন্ড লজ্জায় লাল হলো। স্বর্গের দেবদূত
ওকে একি কথা শোনাচ্ছে! মাথা নেড়ে বললো, ‘না না, সেটি ঠিক বুলে নাই। সাহাইয্য লিচ্চয়ই করিব। ঈশ্বর তুমাদের
মঙ্গল করিবেন।’
অনেক রাত অবধি বুড়ো ডেসমন্ডের সঙ্গে ওদের কথা হলো। ডেসমন্ডের
মনে হলো, দেবদূতরা ওর জন্যে স্বর্গের বাণী বয়ে এনেছে। ওরা জানে, শিরিষ গাছে পাখিরা
কেন গান গায় না, ঘাসফুলের প্রজাপতিরা কেন আর আসে না, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দের শব্দ আর
রঙ কোথায় হারিয়ে গেছে। ওরা আনন্দের হারিয়ে যাওয়া শব্দকে ফিরিয়ে আনবে। শয়তানের বিষাক্ত
যন্ত্রণার ছায়া পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দেবে। শিরিষের ডালে আবার পাখিরা গান গাইবে। মুগ্ধ
হয়ে ডেসমন্ড ওদের কথা শোনে। ওর ঘোলাটে চোখে আনন্দ নেচে বেড়ায়। বার বার বলে, ‘ঈশ্বর তুমাদের মঙ্গল করিবেন।’
স্বর্গের দেবদূত হাসতে হাসতে ওকে বলে, ‘তোমাকে আমরা শিখিয়ে দেবো
কি করে গ্রেনেড মারতে হয়, আর রাইফেল চালাতে হয়।’