যুক্তিবাদিতায় ও
বিজ্ঞানমনস্কতায় নিহিত
মানসমুক্তি এবং মানবমুক্তিও
উদ্ভিদও প্রাণী, কাজেই
জীব-উদ্ভিদ মাত্রই প্রাণের পরিচর্যার প্রয়োজনে খাদ্য সংগ্রহে
থাকে নিষ্ঠ। আত্মরক্ষণ ও আত্মবিকাশ, আত্মপ্রসার ও আত্মোৎকর্ষ প্রভৃতিত ওই
প্রাণের পরিচর্যারই লঘু-গুরু অংশমাত্র। এটি প্রাণী মাত্রেরই সহজাত চেতন-অবচেতন
বৃত্তি-প্রবৃত্তি-প্রসূত। তাই আমরা উদ্ভিদের
মধ্যে তথা তরুলতার মধ্যে আত্মবিকাশের ও প্রসারের প্রয়াস লক্ষ্য করি, গাছ
যেদিকে সূর্যের আলো আছে, রোদ আছে সেদিকেই এগিয়ে যায়,
দেয়ালের বাধা থাকলে ভিন্নপথে এগুবার চেষ্টা করে। লতাও কাছেপিঠে
তরু খোঁজে বেয়ে উঠবার গরজে, বেড়ে ওঠার আত্মপ্রসারের প্রয়োজনে এবং নিকটতম গাছকেই করে
অবলম্বন।
এমনি আত্মবিকাশের প্রয়াস
সুপ্ত এবং গুপ্ত থাকে সর্বপ্রকার প্রাণীর মধ্যেই। প্রাণীরা শারীর
কারণেই এবং প্রশিক্ষণদাতার অভাবেই আত্মবিকাশে অসমর্থ। কিন্তু দেখা যায়
মানুষ যদি প্রত্যক্ষে কিংবা পরোক্ষে সহায়তা করে, তাহলে তারাও অসাধ্য সাধন
করে। উল্লেখ্য যে আত্মরক্ষার ও আত্মপ্রসারের, খাদ্য সংগ্রহের এবং আশ্রয়
নির্বাচনের বুদ্ধি সব জীব-উদ্ভিদেরই রয়েছে। বলতে গেলে বুদ্ধিই
প্রাণীমাত্রেরই জীবনে পুঁজি ও পাথেয়। এবং মানুষ যে অন্য প্রাণী
থেকে বেশি বুদ্ধিমান, তা নিঃসংশয়ে বলা চলে না। মানুষ ঋজু মেরুদণ্ডে
খাড়া থেকে দু’হাতের প্রয়োগে
এবং একে অপরের সাহায্যে সহযোগিতায় মগজ-মনন-মনীষার ও অনুশীলনজাত বুদ্ধিযোগে অনন্য, অসামান্য
হয়ে প্রকৃতিকে দাস-বশ করেছে, প্রকৃতিকে
এগিয়ে কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে আপোস করে স্বরচিত স্বনির্ভর কৃত্রিম জীবনযাপনে সমর্থ হয়েছে,
রোগ-বৃষ্টি-শৈত্য
থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। সামুদ্রিক প্রাণীরা, খেচর
প্রাণীরা, স্থলচর প্রাণীরা, আর উদ্ভিদরাও
আর্তব প্রভাব সচেতন। কোন কোন বৃক্ষ যেমন শীতকালে
পত্রহীন নয়, তেমনি ঔষধির মূলও থাকে মাটির গর্ভে সুপ্ত, সীলমাছ যেমন থাকে বরফের কন্দরে, সাইরেরিয়ার পাখিরা
যেমন আশ্রিত হয় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে।
মানুষ দু’হাতের বদৌলত সূর্যের নৈকট্য-দূরত্বজাত
পৃথিবীর আর্তব আবহাওয়ার উপদ্রব থেকে আত্মরক্ষা করে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বাস করতে
সমর্থ। তাই দেশ-দুনিয়ার সর্বত্র মানুষ মেলে। কিন্তু পৃথিবীর
আর আর জীবন-উদ্ভিদমাত্রই আঞ্চলিক, তাই সব বৃক্ষ,
সব জন্তু সর্বত্র মেলে না।
কৃত্রিম জীবন রচনার ও
স্বনির্ভর-স্বয়ম্ভর হওয়ায় সমর্থ মানুষই পৃথিবীতে প্রাণী হিসেবে প্রাধান্য
পেয়ে ভাবে যে পৃথিবীটা মানুষের জন্যেই তৈরি হয়েছে, নির্মাণ
করেছেন স্রষ্টা। ইদানীং পূর্বকালে বিবর্তনতত্ত্ব মানুষের জানা
ছিল না। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে জানা হওয়া সত্ত্বেও আজো লাখে একজনও তা বিশ্বাস করে
না─ শিক্ষিত-অশিক্ষিত অবশেষে। আজো তাই আদিমানব গোষ্ঠীর
ভয়-বিস্ময়-কল্পনা-আঁচ-আন্দাজ-অনুমান প্রসূত আসমানে-জমিনে আকীর্ণ অদৃশ্য অসংখ্য অরি-মিত্র শক্তির রোষমুক্তি,
কৃপা-করুণা-ক্ষমা
প্রাপ্তি লক্ষ্যে-ভয়-ভক্তি-ভরসায় গড়ে-ওঠা বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণানির্ভর জীবনযাপন করে। এরা নিত্যকার জীবন-জীবিকার
ক্ষেত্রে জাগতিক প্রয়োজন মেটানোর ধান্ধায় জাগ্রত মুহূর্তগুলো ব্যয় করে। জীবন কি যে কেন, এর
দায়িত্ব ও কর্তব্য কি, এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি─ এসব প্রশ্ন তাদের মনে জাগলেও,
তা বুদবুদের মতোই ক্ষণস্থায়ী। এ দায়িত্ব নবী-অবতারের,
শাস্ত্রের, ভিক্ষুর-শ্রমণের-রাব্বীর-সন্তের-সন্ন্যাসীর-দরবেশের বলেই তারা জানে ও মানে। তাই সাধারণ মানুষের
মধ্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে কোন সন্দেহ, সংশয়, সন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা জাগে না, সাধারণ মানুষ মুক্তচিন্তা-চেতনার, যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেক-বিবেচনা প্রয়োগের কোন গরজ বোধ করে না, গতানুগতিক
অভ্যস্ত কর্মে-আচারে-আচরণের বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণার অভিব্যক্তি দিয়েই আমজনতা তাদের
বিশ্বাসের ও ভরসার ঐহিক-পারত্রিক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে।
অনায়াসে স্বতোস্ফূর্তভাবে
বৃদ্ধির, বিকাশের ও প্রসারের একটা সীমা আছে, তার বেশিকিছু প্রত্যাশা করলে প্রয়াসের, প্রযত্নের,
সাহায্যের সহায়তার প্রয়োজন আবশ্যিক ও জরুরী হয়ে ওঠে।
আগেই বলেছি, বুদ্ধিই
প্রাণীমাত্রেরই সম্বল, কিন্তু বুদ্ধির বিকাশের, উৎকর্ষের ও প্রয়োগের জন্য অপরের সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সব প্রাণীই প্রশিক্ষণে
স্ব স্ব সুপ্ত ও গুপ্ত শক্তিকে বিকশিত ও কেজো করে তুলতে পারে। তার প্রমাণ গৃহপোষ্য
বাজ-পায়রা, ময়না-শুক,
লড়াকু মোরগ, হাতি, ষাঁড়, মোষ, ঘোড়া,
কুকুর, বেড়াল, নকুল
প্রভৃতি নয় কেবল, শাহজালালের দরগার গজার মাছ, খান জাহান আলি খাঁর দীঘির কুমির কিংবা বায়েজিদ বিস্তামীর দরগাহর কমঠে নয়,
ডলফিনেও বিস্ময়করভাবে মেলে, আর মেলে সারকাসের
বাঘে, সিংহে, বানরে, হাতিতে, ঘোড়ায় ছাগলেও।