অবাক বাড়ির সিংহ দরজা
ছেলেরা খেলতে খেলতে এসে যায় এ জায়গায়। সামনেই এক প্রাচীন প্রাসাদ। ঝোপঝাড়ের আড়ালে একধরনের একটা প্রাসাদ আছে ওরা ভাবতেই পারেনি। ঝোপের ওপাশে খেলার মাঠ। ওখানেই ওরা ফুটবল খেলছিল। প্রতিদিনই খেলে। ঝোপের এপাশে ওদের আসা হয়নি কখনো। আসলে ঝোপটি নিয়ে অনেক ভয় জাগানো গাল গল্প রয়েছে। এ ঝোপে যে কেউ ঢোকে, তাকে আর দেখা যায় না কোনদিন। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। কেউ যদি কখনো ঝোপ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে, তাকে আর জ্যান্ত দেখা যায় না। তার লাশ পড়ে থাকে ঝোপের পাশে। গেল বছর এমনি পরিণতি হয়েছিল কামাল পাগলার। তাইরে নাইরে গান গাইতে গাইতে সে নিজের খেয়ালে ঢুকে পড়েছিল ঝোপের ভেতর। তারপরই তার ভীতিকর আর্তনাদ শুনেছিল কেউ কেউ। তারপরই আর কোন সাড়া নেই। পরের দিন ঝোপের আশে পাশে তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। কিভাবে সে মারা গিয়েছিল পোস্টমর্টেম করে তার কোন হদিসই পাওয়া যায়নি। কালে-ভদ্রে কেউ-ই ভুলেও ঢোকে না এই ঝোপঝাড়ে।
ছেলেরা ফুটবল খেলছিল ঝোপের পাশের মাঠে। প্রতিদিনই খেলে বিকেল বেলায়। কালামের বেশ লম্বা লম্বা কিক দেয়ার অভ্যাস। এমনি এক কিকে বল উড়ে যায় ঝোপের দিকে। ওদের আর কোন বল নেই। অনেক কষ্টে চাঁদা তুলে বলটি কিনেছিল। বলটি যখন উড়তে উড়তে ঝোপের ভেতর সেঁধিয়ে গেল, তখন ওরা সবাই হা হা। কি করবে ভেবেই পেল না। শেষে রায় হল: কালামের কিকে বল ঢুকেছে ঝোপে। সুতরাং সে-ই ঢুকবে সেখানে। খুঁজে পেতে নিয়ে আসবে বল। এমনিতেই লম্বা কিক করার অপরাধ বোধে কালামের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়েছিল, সবার কাছ থেকে এই রায় শুনে সে ফ্যাৎ করে কেঁদেই দিল।
জহির সবসময় বিজ্ঞের মত ভাব-সাব করে। সে গম্ভীর-গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল : না। তা হয় না। লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড দেয়া যায় না।
কথাটা সে কদিন আগে বড় চাচার কাছ থেকে শুনেছে, চান্স পেয়ে ছেড়ে দিল বন্ধুদের মধ্যে।
জাহান ছোটখাট মানুষটি হলে কি হবে, সে এক মহা-ফচকে। ফোঁৎ করে নাক ঝেড়ে বললঃ খুব দরদ দেখছি! তাহলে তুই যা না, ভূতুড়ে ভূতুড়ে জঙ্গলটায় ঢুকে আমাদের সোনার টুকরো বলটা নিয়ে আয়।
জহির তার বড় চাচার মত গুরুগম্ভীর চালে বলল : এটা কোন কাজের কথা হল! কালাম যাওয়া যা, আমি যাওয়াও তাই। ঐ জঙ্গলে ঢুকে আমরা কেউ জ্যান্ত বেরুতে পারব না।
সবাই সমস্বরে বলে উঠল : তাহলে?
জাহান বলল : তাহলে আর কি? কেউ জঙ্গলে ঢুকে বল দেখবে না, বল তো আর নিজে এসে আমাদের পায়ে এসে হুমড়ী খেয়ে পড়বে না!
তাহলে বল নেই, আমাদের খেলাও খতম।
জহির বলল : বললেই হল, খেল্ খতম। সব কিছুতেই এক সাথে থাকতে হয়। ডিসিশন নিতে হয়। এটাই গণতন্ত্র।
একথাটাও তার বড় চাচার মুখ থেকে শুনেছে।
সবাই মাঠের মাঝখানে গোল হয়ে বসল। অনেক বাকবিতণ্ডা তর্কাতর্কির পর সিদ্ধান্ত হল, সবাই মিলে একসাথে জঙ্গলের ভিতর ঢুকবে। দল বেধে বল খুঁজবে।
এই সিদ্ধান্ত নিয়েই ওদের সবার ঝোপঝাড়ে ঢোকা। বল খুঁজতে খুঁজতে ওরা এসে পড়ে এ জায়গায়। ওদের ঠিক সামনেই প্রাচীন প্রাসাদ। পলেস্তারা খসে পড়েছে। প্রাসাদের দেয়াল জুড়ে আগাছার ভীড়। সামনেই মরিচা ধরা লোহার ভারি গেট। গেটের দু’পাশে দু’টি মার্বেল পাথরের সিংহমূর্তি। আশ্চর্য, মার্বেল পাথরের সিংহ দু’টি ঝকঝকে। ওরা অবাক হয়ে প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রাসাদটি কোমর সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেট থেকে একটা খোয়া বিছানোর রাস্তা গিয়েছে প্রাসাদের দিকে।
ওরা কৌতূহলী সাহসের ওপর ভর দিয়ে গেট ধরে ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ তুলে তা ফাঁক হয়ে গেল। ঝোঁকের মাথায় ছেলের দল ভেতরে ঢুকে পড়ল। রাস্তাটা মোটামুটি পরিষ্কার হলেও চারপাশে আগাছার দঙ্গল। সেখানে ফুটে আছে নাম না জানা বিভিন্ন ফুল। অবাক করা ব্যাপার হল, আগাছার এই দঙ্গল রাস্তাটার ওপর হামলা চালায় না কেন? বোধ কেউ যত্ন নিয়েছে রাস্তাটির ওপর।
ওরা রাস্তা ধরে এগিয়ে এল প্রাসাদটির কাছে। টানা লম্বা বারান্দা। মার্বেল পাথরের বিশাল বিশাল খাম। খামের মাথায় থাবা পেতে বসা সিংহমূর্তি। তার ওপর ছাদ। যেন সিংহগুলো তাদের মাথায় বারান্দার ছাদ নিয়ে বসে রয়েছে। ওরা বারান্দায় উঠে এল। বেশ বড় বড় জানালা প্রাসাদটিতে। সবগুলো জানালা কাঠের কপাটে বন্ধ। এতবড় বাড়িটির একটিমাত্র দরজা। বেশ উঁচু ও প্রশস্ত। সেগুন কাঠের। ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার ঠিক ওপরেই বিশাল এক তৈলচিত্র। একটি সিংহ শিকার ধরার লক্ষ্যে লাফ দিচ্ছে।
ওরা দেখতে পেল, দরজার পাশে একটি কলিং বেলের বোতাম রয়েছে। ওরা পরস্পরের দিকে তাকাল। ওরা প্রত্যেকেই ভেতর-বাড়িটা দেখার জন্য উসখুস করছে। ভেতরে কেউ কি আছে? কোন লোক? নাকি অশরীরী কিছু?
জহির ভয়ে ভয়ে কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল। মুহূর্তে পুরো প্রাসাদটি যেন কেঁপে উঠল। দরজার ওপরে শিকাররত সিংহের তৈলচিত্রটি বিদ্যুৎ চমকের মত উদভাসিত হয়ে উঠল। জ্বলে উঠল সিংহের চোখ দু’টি। প্রাসাদ জুড়ে শোনা যেতে লাগল সিংহের গর্জন। তৈলচিত্রের সিংহী যেন জ্যান্ত হয়ে অমনি ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের ওপর।
ভয়ে কেঁপে উঠল ওরা সবাই। হুড়মুড় করে ওরা নেমে এল বারান্দার ওপর। পড়ি মরি করে ছুটে পাঁচিল ঘেরা প্রাসাদের গেট দিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। দেখতে পেল, গেটের সিংহ দু’টিও যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। ওদের চোখ দিয়ে সার্চ লাইটের মত আলো ঠিকরাচ্ছে। কখনো লাল আলো, কখনো সবুজ। রহস্যময় এই আলোর দ্যুতি, সিংহের পিলে চমকানো গর্জন আর ভূতুড়ে এই প্রাসাদ থেকে যতদূরে থাকা যায়, ততই ভাল। ওরা একছুটে ঝোপঝাড় ফুঁড়ে খেলার মাঠে ফিরে এসে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল।
“ ” - Mahad Uddin Mahid